| রবিবার, ১০ এপ্রিল ২০২২
দেশবিদেশ রিপোর্ট
‘তোমরা মোরশেদ বলীকে বাঁচাতে কেউ আসবে না, তাকে মেরে ফেলার জন্য উপরের নির্দ্দেশ আছে।’ কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল ও ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ন সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রকাশ্য একটি বাজারে এমন হুশিয়ারি দিয়ে একজন প্রতিবাদী মানুষের হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় চাঞ্চল্যকর মোরশেদ বলী হত্যাকান্ডটি নিয়ে কক্সবাজার সদও মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় উক্ত নেতাদ্বয় সহ ৩৫ জন আসামী রয়েছেন। তন্মধ্যে ২৬ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। আসামীদের মধ্যে অন্তত ১৫/১৬ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগটেনর নেতাকর্মী। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগটনের দুই তৃণমূল নেতা ‘উপরের নির্দ্দেশ’ প্রাপ্ত হয়ে একজন নীরিহ ব্যক্তিকে শত শত মানুষের সামনে পৈশাচিকভাবে হত্যার ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে। পবিত্র রমজান মাসে একজন রোজাদার মানুষকে ইফতারি কিনার সময় একদম প্রকাশ্য দিনের বেলায় এমন নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি বিবেকবান মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। ৩০/৩৫ জন সন্ত্রাসী বাজারের একটি গলি ঘিরে বন্দুক, ধারালো দা, হাতুড়ি, ছোরা, কিরিচ ও লোহার রড দিয়ে এ জঘন্য হত্যাকান্ড ঘটায় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
একজন নীরিহ মানুষকে হত্যা করার জন্য ‘উপরের নির্দ্দেশ’ থাকার বিষয়টি এখন ‘টক অবদ্য কক্সবাজার’ হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে কক্সবাজার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক মাহমুদুল করিম মাদুর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন-‘ নৃশংস হত্যাকান্ডের সময় এমন কথাটি পিএমখালী ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ন সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেছেন বলে শুনেছি। তবে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল এমন কথা বলেছেন বলে শুনিনি।’ কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন, মামলার এজাহারে আসামী হওয়া সকল দলীয় নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোরশেদ বলী নামের প্রবাসী ব্যক্তিকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি নেতা (জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দল নেতা)ও সাবেক মেম্বার মোহাম্মদুল হকের সাথে ঝগড়াকে কেন্দ্র করে। আর পুরো হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগটনের তৃণমূল নেতাদের নেতৃত্বে। লোকজন বলছেন, রাজনীতির আদর্শে বিভক্ত হলেও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের পিএমখালী এলাকার নেতাকর্মীরা খুনোখুনীতে একাকার হয়ে পড়েছেন। তাও আবার হত্যাকান্ড ঘটানোর জন্য বিএনপি নেতা মোহাম্মদুল হকের দুই ভাই মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ ও ছৈয়দুল হক সুদুর সৌদি আরব থেকে বিপুল অংকের টাকা নিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। বাজারে হত্যাকান্ড ঘটার জন্য যখন সংঘবদ্ধ খুনীর দল মোরশেদকে ঘিরে ধরেছিল তখন রোজাদার মোরশেদ তাদের কাছে আকুতি জানিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে বলেছিলেন-‘ আমি রোজাদার। আমাকে তোমরা মেরেই যখন ফেলবে তবে ইফতারটা করার সময় দাও।’ প্রত্যক্ষদর্শী আবু তাহের এ কথা জানিয়ে আফসোসের সুরে বলেন, নরপিশাচরা সেই সুযোগটিও দিল না।
গত বৃহষ্পতিবার বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৪ টার দিকে পিএমখালী ইউনিয়নের চেরাংঘর ষ্টেশন বাজারে ইফতারি কিনতে গিয়ে খুনের শিকার হন ওই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোরশেদ আলী প্রকাশ মোরশেদ বলী (৪০)। মোরশেদ বলী এক দশক ধরে পরিবার নিয়ে সৌদি আরবে প্রবাস জীবনের পর দুই বছর আগে গ্রামে ফিরেন। তিনি গ্রামে এসে মাছের ঘের সহ ক্ষেত-খামার করতে শুরু করেন। এলাকায় আসার পর থেকে পানি সেচ প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক মেম্বার মোহাম্মদুল হকের সাথে বিরোধের সৃষ্টি হয়।
ঘটনার সময় নিহত মোরশেদ বলী যখন চেরাংঘর ষ্টেশনের তরকারি দোকানের সামনে এসে কেনাকাটা করছিলেন তখনই আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল মোস্তফা আলাল এবং যুবলীগ নেতা জয়নাল আবেদীন গলিটি ঘিওে লোকজনের আসা যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়। এসময় দুইজনই সমস্বরে বলতে থাকেন-উপরের নির্দ্দেশ আছে মোরশেদ বলীকে মেওে ফেলার জন্য। এমন হুশিয়ারির সাথে সাথেই মামলার এক নম্বর আসামী যুবলীগ নেতা আবদুল মালেক তার হাতের লম্বা কিরিচ নিয়ে প্রথমে মোরশেদের মাথা লক্ষ্য করে কোপ মারে। এরপর সৌদি আরব থেকে হত্যার মিশন নিয়ে আসা আসামী মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ হাতুড়ি দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মোরশেদের অন্ডকোষে বার বার আঘাত করে।
ঘটনার অন্যতম প্রধান নায়ক আসামী মোহাম্মদুল হক এ পর্যায়ে ধারালো কিরিচ দিয়ে মোরশেদেও ডান হাতের কব্জিতে কোপ দিয়ে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এরপর জাহাঙ্গীর আলম, মতিউল ইসলাম, ছৈয়দুল হক, হামিদুল হক, তাহেরুল ইসলাম, ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও মেম্বার আরিফুল্লাহ, আক্কাস, শাহিন, খোরশেদ আলম, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী প্রকাশ আলী ভাইয়ের ভাই মাহমুদুল করিম ও গ্রেফতার হওয়া দিদারুল আলম, আবদুল্লাহ, আবদুল আজিজ, আবদুল হাই, উমর ফারুক, ইয়াছিন, সাইফুল ইসলাম, ওসমান, আজহারুল ইসলাম ও জাহেদুল ইসলাম সহ অন্যান্যরা ছোরা, লোহার রড দিয়ে মোরশেদকে উপর্যুপরি আঘাতে আঘাতে ঝাঝরা করে ফেলে। এলাকার লোকজনের মতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু নিশ্চিত করে সংঘবদ্ধ খুনীর দল এলাকা ছাড়ে।
নিহত মোরশেদ বলীর ছোট ভাই ও মামলার বাদী শিক্ষানবীশ আইনজীবী জাহেদ আলী জানান-‘ স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের এগার জনের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে আমাদের এলাকাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছিল। তারাই আমাদের পরিবারের সেচ পাম্পটি দখলে নিয়ে কৃষকদের জিন্মী করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছিল। এমনকি সিন্ডিকেট সদস্যরাই এলাকায় করছিলেন ভুমিদস্যুতা থেকে যাবতীয় অপকর্ম।’
তিনি বলেন, নিহত মোরশেদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটু প্রতিবাদী ছিলেন। তিনি সিন্ডিকেটের অবৈধ কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়েই খুনের শিকার হলেন। মামলার বাদী জাহেদ আলী জানান, সাবেক ইউপি মেম্বার ও বিএনপি নেতা মোহাম্মদুল হক সেচ পাম্পটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তার চাচাত ভাই এবং ইউনিয়ন যুবলীগের সহ সভাপতি আবদুল মালেকের মাধ্যমে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে সিন্ডিকেটটি গঠনে অন্যতম ভুমিকা পালন করেন।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুনীর উল গীয়াস জানিয়েছেন- ‘মোরশেদ হত্যাকান্ডের বিষয়ে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মামলার ৩ আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ আসামীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছে।’
আদেবি/জেইউ।
Posted ২:৩১ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১০ এপ্রিল ২০২২
dbncox.com | ajker deshbidesh