শুক্রবার ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম
শিরোনাম

সেই মা সেই ছবি

  |   শনিবার, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

সেই মা সেই ছবি

মা সীমা সরকারের কোলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে ছেলে হৃদয় সরকার। ছবি: এম এ আল মামুন মা সীমা সরকারের কোলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে ছেলে হৃদয় সরকার।

মায়ের কোলে বসে প্রতিবন্ধী সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের মন ছুঁয়েছিল ছবিটি। সেই মা সীমা সরকার। সম্প্রতি বিবিসির ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন তিনি। সীমা সরকারকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর ছেলে হৃদয় সরকার। আলোচিত ছবিটি তুলেছিলেন এম এ আল মামুন। শুনিয়েছেন ছবি তোলার গল্প।

দুর্ভাগ্যের শুরু আমার জন্মের সময়েই। ভুল করে মেয়াদোত্তীর্ণ অক্সিজেনের মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল মায়ের মুখে। ফলে মা তো গুরুতর অসুস্থ্ হয়ে পড়েনই, সঙ্গে আমার মস্তিষ্কের ওপর পড়ে প্রচণ্ড চাপ। আমি জন্মের পর তাই তিন ঘণ্টা কাঁদিনি। আমাকে কাঁদাতে গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা করে বসেন আরেকটা ভুল। মেয়াদোত্তীর্ণ ইনজেকশন পুশ করেন আমার শরীরে। ফলাফল, আমার শরীরের কোমরের নিচ থেকে অবশ হয়ে যায়।

ব্যাপারটা আমার মা বুঝতে পারেন আমার ছয় মাস বয়সে, যখন আমি আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতো বসতে পারছিলাম না। ওই বয়সে তো বসতে পারার কথা। সেই থেকে শুরু আমার মায়ের সংগ্রাম। এ ডাক্তার–সে ডাক্তার, এ হাসপাতাল, সে হাসপাতাল, এমনকি ভারতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তাতে কী? মা ভেঙে পড়বেন? মোটেও না। তিনি পণ করলেন, তাঁর এই শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে আর দশটা স্বাভাবিক ছেলের মতোই মানুষ করবেন।

আমার বয়স যখন ছয়, তখন মা আমাকে কোলে করে নিয়ে গিয়ে নেত্রকোনার ‘দ্য হলি চাইল্ড একাডেমি’ নামের স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। সেখানে প্রাথমিক শেষ করে আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। স্কুলটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। মাঝেমধ্যে রিকশা পাওয়া যেত না। মা পুরোটা পথ আমাকে কোলে করে নিয়ে যেতেন। শুধু তা–ই নয়, পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অংশ নিতাম আমি। ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি। ক্রিকেটে উইকেট কিপার ছিলাম, ফুটবলে ছিলাম গোলরক্ষক। এসব জায়গায় মা আমাকে কোলে করে নিয়ে যেতেন।

এভাবে এসএসসি পাস করার পর ভর্তি হই নেত্রকোনার আবু আব্বাস ডিগ্রি কলেজে। কলেজটাও ছিল ও রকম এক কিলোমিটার দূরে। মা আগের মতোই কোলে করে নিয়ে যেতেন, আবার নিয়ে আসতেন। টানা দুই বছর আমার কলেজজীবন চলে এভাবেই। আমি এইচএসসি পাস করি। মা স্বপ্ন দেখেন আমাকে আরও পড়ালেখা করাবেন। এ সময় মায়ের স্বপ্নকে আরও উসকে দেন আমাদের নেত্রকোনারই এক বড় ভাইা নাঈম আহমেদ, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়েন। তিনি মাকে বলেন, আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে। এ বছর রমজানের ছুটিতে বাড়িতে এসে নাঈম ভাই আমাকে ভর্তির পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক সাহায্যও করেন।

এরপর ভর্তি পরীক্ষার আগে আগে মা আমাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয়-৭১ হলে আসেন। এই হলেই নাঈম ভাই থাকেন। পরীক্ষার আগের দিন আমাকে ‘পরীক্ষার হল পর্যন্ত কোলে করে দিয়ে আসতে চান’ মর্মে একটি আবেদনপত্র লিখে মা ডিন অফিসে যান। ডিন স্যার অনুমতি দেন। পরীক্ষার দিন মা আমাকে কোলে করে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষার হলে বসিয়ে দিয়ে বাইরে বারান্দায় অপেক্ষা করেন। পরীক্ষা শেষ হলে আবার আমাকে কোলে করে নিয়ে যান।

মা সীমা সরকারই ছেলে হৃদয় সরকারের বড় আশ্রয়। ছবি: সংগৃহীত
মা সীমা সরকারই ছেলে হৃদয় সরকারের বড় আশ্রয়। ছবি: সংগৃহীত
তারপরের গল্প আপনারা জানেন। আমি এখন ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় আছি। আমার ইচ্ছা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ার। তারপর কূটনীতিক হয়ে দেশের সেবা করার।

আমি হৃদয় সরকার, আজ যে এত স্বপ্নের কথা বলতে পারছি, এত দূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি, তা শুধু আমার মায়ের জন্য। মা সম্প্রতি বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এতে কার না আনন্দ হয় বলুন? আমি ভীষণ আনন্দিত। আমার মা সীমা সরকারের জন্যও এটা নিঃসন্দেহে অনেক গর্বের। আমাকে নিয়ে মায়ের যে সংগ্রাম, এটা তার স্বীকৃতি। তবে মা মনে করেন, আমি যদি মানুষের মতো মানুষ হতে পারি, তবে সেটাই হবে আমার মায়ের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি।

মায়ের এই স্বপ্ন পূরণের জন্য আমি যদি জীবনটা উৎসর্গ করতে পারতাম!

Comments

comments

Posted ১:৫১ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

dbncox.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

দশ বছর পর
দশ বছর পর

(1548 বার পঠিত)

(1145 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

প্রকাশক
তাহা ইয়াহিয়া
সম্পাদক
মোঃ আয়ুবুল ইসলাম
প্রধান কার্যালয়
প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত এবং দেশবিদেশ অফসেট প্রিন্টার্স, শহীদ সরণী (শহীদ মিনারের বিপরীতে) কক্সবাজার থেকে মুদ্রিত
ফোন ও ফ্যাক্স
০৩৪১-৬৪১৮৮
বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন
01870-646060
Email
ajkerdeshbidesh@yahoo.com