বৃহস্পতিবার ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম
শিরোনাম

সময় এখন তাওবা করার

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানি   |   সোমবার, ০৬ এপ্রিল ২০২০

সময় এখন তাওবা করার

গুনাহ একটি মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক আত্মিক ব্যাধি। গুনাহ এমন একটি ক্ষতিকর জিনিস, যার দ্বারা মানুষের অন্তরে জং পড়ে যায়। অন্তর কালো হয়ে যায়। তবে গুনাহের উত্তম চিকিৎসা হলো তাওবা। করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমান বিশ্ব আজ স্তব্ধ-স্তম্ভিত। শহর-গ্রাম-নির্বিশেষে সবখানে বয়ে চলছে রিক্ততার বাতাস। ঠিক এ মুহূর্তে আমাদের দরকার আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ তাওবা। মহান রবের কাছে আত্মসমর্পণ।

মানুষ ভুল ও পদস্খলনের শিকার। গুনাহ করা তার স্বভাবগত অভ্যাস। কিন্তু উত্তম গুনাহগার ওই ব্যক্তি যে গুনাহর কারণে লজ্জিত হয়। আল্লাহর কাছে অশ্রু বিসর্জন দেয়। তাঁরই দিকে ফিরে আসে। করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ভবিষ্যতে গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

তাওবা মূলত তিন জিনিসের সমষ্টির নাম। একটি হলো বিগত দিনগুলোতে যে গুনাহগুলো হয়ে গেছে এর মন্দ পরিণামের ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরে খুব অনুশোচনা সৃষ্টি হওয়া। দ্বিতীয়টি হলো, তত্ক্ষণাৎ গুনাহ করা ছেড়ে দেওয়া। তৃতীয়টি হলো, সামনের দিনগুলোতে গুনাহ না করার দৃঢ় ইচ্ছা করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিমতো তাঁর আনুগত্য করে চলার সংকল্প গ্রহণ করা। এই তিন জিনিস পরিপূর্ণভাবে পাওয়া গেলে তাওবা পূর্ণাঙ্গতা পায়।

তাওবাকারীদের জন্য সুসংবাদ : কোরআন ও হাদিসে তাওবাকারীদের জন্য সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহপাক তাওবাকারীদের পছন্দ করেন। ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখেন। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২২)

কোরআনে কারিমে আরো বলা হয়েছে, ‘আপনি বলুন, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের সত্তার প্রতি সীমাহীন জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করে দেবেন; নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৩)

হাদিসে এসেছে, ‘সব আদম সন্তানই গুনাহগার, গুনাহগারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তাওবাকারীরা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৯৯; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৫১)

তাওবা মানুষকে সফলতার উচ্চমার্গে পৌঁছে দিতে পারে। এর মাধ্যমেই অন্তরের কালো জং দূর হয়। এই তাওবার মাধ্যমেই বড় বড় গুনাহগার এবং নিরাশ লোক পৌঁছতে পারে মানজিলে মাকসুদে। আসতে পারে ইসলামের ছায়ায়। কত বড় গুনাহগার আল্লাহর নবীর কাছে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলে নবীজি (সা.) তাদের নৈরাশ্যতা দূর করেছেন। দিয়েছেন তাদের সুসংবাদের বাণী। একবার এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি জীবনে সব রকমের গুনাহ এত পরিমাণ করেছি, যদি ওই সব গুনাহগুলোকে দুনিয়ার সব মানুষের ওপর বণ্টন করে দেওয়া হয়, তবে সব মানুষ জাহান্নামি হয়ে যাবে। আল্লাহর রাসুল এতসব গুনাহের ক্ষতিপূরণের কি কোনো পথ আছে? আল্লাহর নবী (সা.) তাকে নিরাশ করেননি। বরং ওই ব্যক্তিকে তিনি ঈমান তাজাকরণ এবং আল্লাহ অভিমুখী হতে নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহর নবীর এই দরদমাখা নির্দেশনা শুনে ওই ব্যক্তির খুশির অন্ত রইল না। হাদিসগুলোতে এ ধরনের অনেক ঘটনা রয়েছে যে গুনাহে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ব্যক্তি আলোর দিশা পেয়েছে। যারা পরবর্তী সময় অন্য মানুষের সঠিক পথপ্রদর্শন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।

মৃত্যুর স্মরণে গুনাহের জং দূর হয়। একবার নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, লোহায় পানি লাগলে যেমন জং ধরে, ঠিক এভাবে গুনাহ সংঘটিত হয়ে গেলে অন্তরে জং ধরে যায়। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এই জং দূর করার উপায় কী? নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করা এবং কোরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা।

মানুষের মন্দ আমলের
কৃষ্ণতা
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যখন বান্দা গুনাহ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। এরপর সে যদি ওই গুনাহ থেকে ফিরে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন এই কালো দাগ নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু যদি সে আবার ওই গুনাহ করে, তখন ওই কালো দাগ আরো বৃদ্ধি ঘটে। শেষ পর্যন্ত তার সম্পূর্ণ অন্তর কালো দাগে ছেয়ে যায়। এটাই ওই ‘রাইন’ শব্দের অবস্থা, যার আলোচনা আল্লাহ তাআলা এভাবে করেছেন, ‘না, কখনো এরূপ নয়, বরং তাদের অন্তরগুলো তাদের (গর্হিত) কার্যকলাপের মরিচা ধরেছে।’ (সুরা : তাতফিফ, আয়াত : ১৪)

নবী করিম (সা.)-এর বাণীর মর্মার্থ হলো, যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা এবং গুনাহে লিপ্ত হয়। তখন সর্বপ্রথম এই গুনাহের ক্রিয়া অন্তরে পড়ে। অন্তরটা তখন নিকষ কালো হয়ে যায়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৪৪)

অন্তরে কালো দাগ পড়া মূলত মানুষের গুনাহের কৃষ্ণতা। আর এই কৃষ্ণতার নামই কোরআনুল কারিমে ‘রাইনুন’ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘না, কখনো এরূপ নয়, বরং তাদের অন্তরগুলো তাদের (গর্হিত) কার্যকলাপের মরিচা ধরেছে।’ একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘মানুষের শরীরে একটি গোশতের টুকরা আছে। যদি এই গোশতের টুকরাটি ভালো হয়ে যায় তাহলে পূর্ণ শরীর ঠিক হয়ে যায়। আর যদি ওই গোশতের টুকরাটি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে পূর্ণ শরীর নষ্ট হয়ে যায়। স্মরণ রেখো! গোশতের এই টুকরাটির নামই অন্তর।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫৯৯)

তাওবার দরজা খোলা

বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করে নিজেদের অন্তর থেকে গুনাহের জং দূরীভূত করতে থাকা উচিত। সাওয়াবের প্রত্যাশায় হিসাব-নিকাশ করতে থাকা। যাতে দুনিয়া আখিরাতের সফলতা ও কামিয়াবি দ্বারা সাফল্য অর্জন করা যায়। কেননা তাওবার দ্বার সব সময় উন্মুক্ত। আল্লাহ তাআলার কুদরতি হাত আমাদের মাফ দেওয়ার জন্য সব সময়ই অগ্রসরমাণ। এ মর্মে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবা করো; তবেই তোমরা নিঃসন্দেহে সফলতা লাভ করবে।’ (সুরা : নূর, আয়াত : ৩১)

অন্যত্র আল্লাহপাক বলেন, ‘যে গুনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১১০)

কিয়ামত পর্যন্ত তাওবা কবুল হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, আবু মুসা আশআরি (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ রাতে তাঁর হাত মুবারক সম্প্রসারণ করেন, যাতে দিনের পাপীরা তাওবা করতে পারে। আবার দিনে তাঁর হাত মুবারক প্রসারিত করেন, যাতে রাতের পাপীরা তাওবা করতে পারে। এ অবস্থা সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়া (কিয়ামত) পর্যন্ত চলতে থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৫৯)

দৈনিক ৭০ বার তাওবা করলেও মাফের আশ্বাস আছে। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইস্তিগফার করে (গুনাহে লিপ্ত হওয়ার পর লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা) পরে তাওবা করে, তবে তা বারবার হিসাবে গণ্য হবে না; যদিও সে ব্যক্তি দৈনিক ৭০ বারও এরূপ করে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫১৪)

আরেকটি হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আমি দিনে ১০০ বার তাওবা করি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭০৩৪)

মৃত্যু পর্যন্ত তাওবা কবুলের সুযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন, ‘রুহ গলদেশে এসে আটকাবার পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহপাক বান্দার তাওবা কবুল করেন।’ (মিশকাত, হাদিস : ২৩৪৩)

তাওবার বরকত

তাওবা ও ইস্তিগফারে লেগে থাকলে দুনিয়ায় সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা, শারীরিক সুস্থতা ও আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়। আর আখিরাতের ফায়দা ও বরকত তো আছেই। নূহ (আ.)-এর ভাষায় পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘অতঃপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী-নালা প্রবাহিত করবেন।’ (সুরা : নূহ, আয়াত : ১০-১২)

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ।

Comments

comments

Posted ১০:১৯ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৬ এপ্রিল ২০২০

dbncox.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

সেহরী
সেহরী

(1759 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

প্রকাশক
তাহা ইয়াহিয়া
সম্পাদক
মোঃ আয়ুবুল ইসলাম
প্রধান কার্যালয়
প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত এবং দেশবিদেশ অফসেট প্রিন্টার্স, শহীদ সরণী (শহীদ মিনারের বিপরীতে) কক্সবাজার থেকে মুদ্রিত
ফোন ও ফ্যাক্স
০৩৪১-৬৪১৮৮
বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন
01870-646060
Email
ajkerdeshbidesh@yahoo.com