দেশবিদেশ প্রতিবেদক: | শনিবার, ২০ মার্চ ২০২১
কক্সবাজারে বঙ্গোপসাগর ও বাকঁখালী নদীর মিলন মোহনায় সবুজ আর শত প্রাণবৈচিত্রের অপূর্ব প্রাকৃতিক স্থান প্যারাবনটি যেন ‘মিনি সুন্দরবন’। এই ‘মিনি সুন্দরবন’এ গোলপাতা বাইন, মরিচ্যা বাইন, কেওড়া, রাজকাটা সহ নানা প্রজাতির শ্বাসমূলী উদ্ভিদের ম্যানগ্রোভ বনটি যেন সবুজে রঙ ছড়াচ্ছে। নানা প্রজাতির অসংখ্য গাছের ঢালে ঢালে নির্বিঘেœ উড়ে বেড়ায় ঝাঁকে-ঝাঁকে বক ও পরিযায়ী পাখি। এ ছাড়াও নিয়মিত জোয়ারের পানি থাকায় নানা প্রজাতির মাছ, কাকড়া সহ সামুদ্রিক প্রাণীর বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দেখে মনে হবে এ বুঝি আরেক সুন্দরবন। স্থানীয় জনগণের অভিমত এখানে প্যারাবন সৃজনের ফলে বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক দূর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস হতে তাদেরকে রক্ষা করতে প্যারাবনটি সহায়তা করছে। প্যারাবনটি প্রাকৃতিক দূর্যোগে সাগরের প্রাকৃতিক দেয়াল বা রক্ষা কবচ হিসাবে কাজ করছে।
প্যারাবনটিতে এখন নিশি বক, সাদা বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, কোয়েল, অন্যান্য সামুদ্রিক পাখি ও অতিথি পাখির বিচরণক্ষেত্র ও আবাসস্থল হিসাবে গড়ে উঠেছে। এ ছাড়াও চিংড়ি, কোরাল মাছের পোনা, বাটা মাছ, বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মৎস্য ও কাঁকড়ার বিচরণক্ষেত্র ও আবাসস্থল হিসাবে গড়ে উঠেছে। কক্সবাজারে ভ্রমণে আসা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে এই ‘মিনি সুন্দরবন’কে আকৃষ্ট করতে নির্মাণ করা হয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও প্রাকৃতিক বিনোদন কেন্দ্র। কক্সবাজারের এই সুন্দরবন এতদঞ্চলের পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস হতে উপকূলবাসীকে রক্ষার লক্ষ্যে ২০০৬ সালে প্রায় ৩১ একর জায়গা জুড়ে এ প্যারাবনটি সৃজন করে বন ও পরিবেশ অধিদফতর। এই ‘মিনি সুন্দরবন’ নিয়ে অনেক স্বপ্ন বন ও পরিবেশ অধিদফতরের।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপÍর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বঙ্গোপসাগর ও বাকঁখালী নদীর মিলন মোহনা কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়ায় বেশ কিছু প্যারাবন ছিল। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী কতিপয় লোকজন প্যারাবনের গাছ কেটে চিংড়ি ঘের তৈরি করে এবং প্যারাবনের জায়গা দখল করে নেয়। ২০০৫ সালে প্রকল্প কর্তৃক স্থানীয় জনগণকে সংঘঠিত করে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নুনিয়ারছড়া গ্রাম সংরক্ষণ দল (ভিসিজি) গঠন করা হয়। পরবর্তীতে সিডব্লিউবিএম প্রকল্প কর্তৃক কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের সহযোগিতায় এবং নুনিয়ারছড়া ভিসিজির সদস্যদের অংশগ্রহণে দখলকৃত প্যারাবনের জায়গা উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত জায়গায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় পরিবেশ অধিদপ্তর ইউএনডিপি’র অর্থায়নে কোস্টাল অ্যান্ড ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি ম্যানেজমেন্ট অ্যাট কক্সবাজার অ্যান্ড হাকালুকি হাওর (সিডব্লিউবিএম) প্রজেক্ট কর্তৃক স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে ২০০৬ সালে নতুন করে প্যারাবনটি সৃজন করা হয়। এরপর নুনিয়ারছড়া ভিসিজিকে প্যারাবন সংরক্ষণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
পরবর্তীতে ২০১৫ সালে পরিবেশ অধিদপÍরের বাস্তবায়নাধীন বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়ণে কমিউনিটি বেইসড এডাপটেশন ইন দ্য ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়াস থ্রু বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড সোশাল প্রটেকশন (সিবিএ-ইসিএ) প্রজেক্ট কর্তৃক প্যারাবনটি রি-জেনারেশন করা হয়। বর্তমানে প্রায় ৩১ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃতি প্যারাবনটি ‘স্ট্রেংদেনিং অ্যান্ড কনসলিডেশন অব সিবিএ-ইসিএ’ প্রজেক্টের মাধ্যমে নুনিয়ারছড়া প্যারাবনটি স্থানীয় জনগণ, নুনিয়ারছড়া গ্রাম সংরক্ষণ (ভিসিজি) সদস্যদের অংশগ্রহণে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এ প্যারাবনটি সংরক্ষণে পরিবেশ অধিদপ্তর পক্ষ থেকে নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্যারাবনের যাতে কেউ ক্ষতি সাধন করতে না পারে সেজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়োগকৃত ৪ জন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকর্মী সার্বক্ষণিক পাহারা ও তদারকি করছে।
নুনিয়াছড়া ইসিএ ব্যবস্থাপনা বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আলম জানান, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি এবং নানাবিধ প্রাকৃতির সৌন্দর্য্য অবলোকন করার সুযোগ রয়েছে। কেউ যাতে গাছপালা ও পাখির ক্ষতিসাধন করতে না পারে সেজন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ৪ জন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকর্মী ও ভিসিজি সদস্যরা সার্বক্ষণিক পাহারা ও তদারকি করছেন। মো. আলম জানান, এই প্যারাবন রক্ষার জন্য স্থানীয় কিছু ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। এমনকি তিনটি মামলার আসামিও হতে হয়েছে।
‘স্ট্রেংদেনিং অ্যান্ড কনসলিডেশন অব সিবিএ-ইসিএ’ প্রজেক্টের দ্বায়িত্বরত অ্যডমিন এসিস্টেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হক জানান, প্যারাবনটিতে এখন নিশি বক, সাদা বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, কোয়েল, অন্যান্য সামুদ্রিক পাখি ও অতিথি পাখির বিচরণক্ষেত্র ও আবাসস্থল হিসাবে গড়ে উঠেছে। এ ছাড়াও চিংড়ি, কোরাল মাছের পোনা, বাটা মাছ, বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মৎস্য ও কাঁকড়ার বিচরণক্ষেত্র ও আবাসস্থল হিসাবে গড়ে উঠেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শেখ মো: নাজমুল হক জানান, এই ‘মিনি সুন্দরবন’এ গোলপাতা বাইন, মরিচ্যা বাইন, কেওড়া, রাজকাটা সহ নানা প্রজাতির শ্বাসমূলী উদ্ভিদের ম্যানগ্রোভ বনটি যেন সবুজে রঙ ছড়াচ্ছে। নানা প্রজাতির অসংখ্য গাছের ঢালে ঢালে নির্বিঘেœ উড়ে বেড়ায় ঝাঁকে-ঝাঁকে বক ও পরিযায়ী পাখি। এ ছাড়াও নিয়মিত জোয়ারের পানি থাকায় নানা প্রজাতির মাছ, কাকড়া সহ সামুদ্রিক প্রাণীর বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এছাড়া শামুক-ঝিনুক, কাঁকড়া, কাছিম ও চিংড়িসহ বহু প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণির দেখা মেলে। সর্বোপরি নুনিয়ারছড়া প্যারাবনটি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ও জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে। সবুজ আর প্রাণির এই অপূর্ব সম্মিলনকে কাজে লাগাতে চায় পরিবেশ অধিদপ্তর।
Posted ১১:২০ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২০ মার্চ ২০২১
dbncox.com | ajker deshbidesh