বৃহস্পতিবার ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম
শিরোনাম

পৃথিবীর যা কিছু হারিয়ে যায়, অন্য রূপে ফিরে আসে জীবনে

দেশবিদেশ অনলাইন ডেস্ক   |   শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০১৯

পৃথিবীর যা কিছু হারিয়ে যায়, অন্য রূপে ফিরে আসে জীবনে

ড. তারিন রহমান

জীবন যেখানে আমার মায়োপ্যাথির কারণে হুইলচেয়ারে আবদ্ধ, সেখানে আমি ক্যান্সারের রোগীদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাই। কারণ আমি জানি স্বপ্ন দেখতে জানলে জীবনের কাঁটাগুলোও ধরা দেয় গোলাপ হয়ে। হতাশা, ব্যর্থতা, গ্লানির তিক্ত অনুভূতিগুলো যখন ঘিরে ধরে, তখন ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সম্বল হয় একটু আশা!

প্রতিটা মানুষের জীবনের একটা গল্প আছে। অতীতে ফিরে গিয়ে গল্পের শুরুটা কখনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তুমি গল্পের শেষটা চাইলেই নতুন করে সাজিয়ে তুলতে পারো।

মায়োপ্যাথির সাথে আমার পরিচয় বহু আগ থেকেই। ১৯৯৬ সালে পোস্ট গ্রাজুয়েশন এর জন্য ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারিতে BSMMU এর MS কোর্সে যখন ভর্তি হই, তখন ঐ সময়ে আমাকে বেশ চাপ নিতে হতো। দিনের অধিকাংশ সময় কলম-কাগজ নিয়ে পড়ে থাকতাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সার্জারি এসিস্ট করতে হতো। কিছুদিন পর ধীরে ধীরে আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু হলো। মায়োপ্যাথির সমস্যাটা প্রকট হয়ে উঠল।

ডাক্তার বলল এমএস কোর্স ছেড়ে দিতে। কাজ থেকে অবসর নিতে। আর নয়তো এরকম চলতে থাকলে আমার শরীরের অঙ্গগুলো আস্তে আস্তে কাজ করা বন্ধ করে দিবে। কিন্তু আমিতো ছাড়ার পাত্র নই। বাবা যে আমার থেকে কিছু চাইতেন। আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তিনি যে আমাকে অসহায় মানুষের আলোর প্রদীপ হিসেবে জ্বলে ওঠাতে চেয়েছিলেন। জীবনে বড় হওয়ার জন্য বড় হতে চাইনি, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ডাক্তারি পেশাটা বেঁচে নিয়েছি। আমি হাল ছাড়িনি। মায়োপ্যাথির কারণে শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও ২০০৪ সালে MS কোর্স সম্পন্ন করি এবং পরবর্তীতে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেই।

১১ ভাই বোনের মাঝে আমরা ছিলাম ৬ বোন ৫ ভাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থাকা সত্বেও আমাদের পরিবারে ভাই-বোনদের প্রাধান্যতায় কখনো পুরুষতান্ত্রিকতা ফুটে উঠেনি। আমার মানসপটে এখনো ভেসে উঠে বাবা আমাদের এমন ব্যবহার শিখিয়েছিলেন যে, সকালের নাস্তা একবার বড় ভাই আর একবার বড় বোন পালা করে তৈরি করতেন। বাবা ব্যক্তিত্বে, সাংগাঠনিকতা, আর দিকনির্দেশনায় ছিলেন অনবদ্য। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাব ডিভিশনাল অফিসার ছিলেন।

তখন ১৯৭১ সাল। বাবার চাকরির পদোন্নতির সুবাদে আমরা ঢাকায় স্থানান্তরিত হলাম। আমার নতুন আবাসস্থল হলো সোবহানবাগ এর অফিসার্স কোয়ার্টারে। ইতোমধ্যে ২৫ মার্চ এর কালোরাত নেমে এলো। আমি এখনো স্পষ্ট করে স্মরণ করতে পারি ২৫শে মার্চের মধ্যরাতের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত গোলাগুলির বিকট শব্দ। মধ্যরাতে যখন গোলাগুলি শুরু হয়, তখন আমার বড়বোন আমাকেসহ আমার ছোটোবোনকে খাট থেকে মাটিতে টান মেরে নামায়। বিষয়টা এমন ছিল যে, আমার ছোটোবোন আতংকে ঘুমের মধ্যেই আর্তনাদ করে ওঠে, ‘মা আমি অন্ধ হয়ে গেছি।’

২৫ মার্চের ওই জারি অবস্থায় আমরা ২৭ মার্চ নৌপথে পালিয়ে নানা বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য পাড়ি জমাই। তখন চারিদিকে ক্ষুধা, হাহাকার, দারিদ্র্য আর শূন্যতার গহ্বর। দারিদ্রের কষাঘাতে নিরুপায় হওয়া মানুষগুলোর হাহাকারে চারিদিক তখনো নিষ্প্রাণ। নানাবাড়িতে দেখতাম মুক্তিকামী মানুষগুলোর জন্য রাত জেগে গ্রাম পাহারা দেওয়ার আর দেশাত্মবোধক গান শোনার মাধ্যমে নিজেদেরকে দেশপ্রেম আগলে রাখার উদ্বোলিত প্রচেষ্টা। তারা ছিলেন রাজকীয় মনের সমুন্নত উদাহরণ। স্মৃতিগুলো আজও আমার মনকে চঞ্চল করে শিহরণ জাগায় সমস্ত প্রাণে।

একাত্তরের ডিসেম্বর মাস। যুদ্ধ শেষ। স্বাধীন বাংলাদেশ। এরই মাঝে যুদ্ধ শেষ হবার পর আমি ধানমন্ডি গভমেন্ট গার্লস স্কুলে ভর্তি হই এবং পরবর্তীতে মাধ্যমিক শেষে ইডেন মহিলা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের জন্য ভর্তি হই।

সেদিন ছিল আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার শেষদিন, বাবার হঠাৎ স্ট্রোক হলো। ফলশ্রুতিতে বাবাকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। বেশ ছোটোবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আমার আলাদা ঝোঁক ছিল। ইচ্ছা ছিলো সাহিত্যেই ক্যারিয়ার করবো। কিন্তু বাবা চাইলেন অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে। তাদের অসহায় চাহনির কাছে একটু আশার প্রদীপ হিসেবে জ্বলে উঠতে। আমি সায় দিলাম। নারী রোগীরা স্বাভাবিক ভাবেই নারী ডাক্তারদের কাছে একটু বেশিই স্বস্তি অনুভব করেন। বাবাও চাইতেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই নারী অসহায় রোগাক্রান্ত মানুষদের পাশে আমাকে দাঁড় করাতে। ইতোমধ্যে আমি ঢাকা বোর্ডের অধীনে উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করি। তারপর এমবিবিএস-এ বরিশাল মেডিকেল আর বিডিএসে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে চান্স হয়। বাবার ইচ্ছায় ডেন্টিস্ট্রি প্রফেশনে আসি।

বিডিএস পাস করার পর ১৯৯৩ সালে ১১তম বিসিএসের মাধ্যমে দোহারে সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। ২০০৪ সালে ডিডিসিতে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেই।

ম্যায়োপ্যাথির সমস্যাটা ইতোমধ্যে বেড়েই চললো। ২০১৩ সাল থেকে আমার হুইল চেয়ার ব্যবহার করা শুরু হয়। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, কিন্তু এই রোগের এখন পর্যন্ত কোনো ভালো ট্রিটমেন্ট আবিষ্কার হয়নি। আমার সমস্ত অঙ্গ হয়ত আস্তে আস্তে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কলেজে যোগদান থেকেই রিসার্সের কাজ শুরু অদ্যাবধি করে যাচ্ছি এবং বর্তমানে আমি ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের ‘ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল”’ ডিপার্টমেন্টের ইউনিট-২ এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত ট্রমার রোগী থেকে শুরু করে ক্যান্সারের রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমার দম একদম ফুরোয়নি। আমার রোগীদের সুস্থতায় প্রতিনিয়ত আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।

আমি আমার শারিরীক প্রতিবন্ধকতাকে কখনোই সমস্যা হিসেবে দেখিনি, যাতে সেটা আমার অগ্রযাত্রায় বেড়াজাল হয়ে না দাঁড়ায়। জীবনে অনেক বিষয় থাকে যেগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, এর বাইরেও তোমার হাতে শত শত জিনিস রয়েছে যেগুলো তুমি বিজয় করতে পারো।

আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একজন সার্জন হিসেবে অসহায় মানুষগুলোর সেবা দিয়ে যেতে চাই। দিনশেষে আমার রোগীদের মুখের হাসি দেখে নিজের মনের হাসির পূর্ণতা দিতে চাই।

আমরা অনেক সময় ভুলে যাই একটু আন্তরিকতার ছোঁয়া, একটা প্রাঞ্জল হাসি, কিছু সুন্দর কথা, সুন্দর ব্যবহারের কি অসম্ভব ক্ষমতা রয়েছে একটা মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার। আমি স্বপ্ন দেখি রোগীদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ‘Treatment Protocol and Research and Publication Centre’ প্রতিষ্ঠা করতে।

বর্তমানের অশিক্ষার অজ্ঞতা আর দারিদ্র্যের দুঃখের হরেকরকম গহ্বর থেকে আমাদের অসহায়, বঞ্চিত রোগীদেরকে মুক্ত করে তাদের পাশে দাঁড়াতে সৎ, দক্ষ চিকিৎসকদের খুব বেশিই প্রয়োজন। নারী চিকিৎসকদের বলতে চাই, জীবনটা মেলে ধরো। রোদে পুড়ে মুকুলের মতো ঝরে পড়লে চলবে না। বুদ্ধিদীপ্ত, সাবলীলতা, জীবনরস, আর হিরন্ময় দীপ্তিছটা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যর্থতা আসতেই পারে। ব্যর্থতা মানে হেরে যাওয়া নয় ‘

তুমি যখন সবাইকে ভালোবাসতে শিখবে, সবার কল্যাণে কাজ করে যাবে, জীবনের প্রান্তি লগ্নে গিয়ে দেখবে মানুষের ভালবাসায় তুমি একদম আকণ্ঠ ডুবে আছো। বিশ্বাস করো, এর চেয়ে পরিতৃপ্তি জীবনে আর কিছুতে হতে পারে না। আর উপরে সৃষ্টিকর্তা একজন তো আছেনই! তার দেনা-পাওনার হিসেবটা নাই বা বললাম।

পৃথিবীর যা কিছু হারিয়ে যায়, অন্য কোনো রূপে সেটি ঠিকই আবার ফিরে আসে জীবনে। তাই কখনো ভেঙে পড়ো না। শহিদুল্লাহ কায়সারের পঙ্ক্তিটি খুব মনে পড়ে-

জীবন একটা নদী

সহস্র ধারায় বহমান,

একটা ধারা শুকিয়ে গেলে,

আরেকটা ধারা প্রবাহমান।

-হিউম্যান অফ ডিডিসি ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া।

লেখক: ড. তারিন রহমান

সহযোগী অধ্যাপক ও ইউনিট ২ প্রধান

ওরাল ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি

ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল

Comments

comments

Posted ১০:২৫ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০১৯

dbncox.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

প্রকাশক
তাহা ইয়াহিয়া
সম্পাদক
মোঃ আয়ুবুল ইসলাম
প্রধান কার্যালয়
প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত এবং দেশবিদেশ অফসেট প্রিন্টার্স, শহীদ সরণী (শহীদ মিনারের বিপরীতে) কক্সবাজার থেকে মুদ্রিত
ফোন ও ফ্যাক্স
০৩৪১-৬৪১৮৮
বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন
01870-646060
Email
ajkerdeshbidesh@yahoo.com