শনিবার ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম
শিরোনাম
কাতার থেকে

কাতারের ঈর্ষণীয় পরিবর্তনের অজানা গল্প

মতিউর রহমান চৌধুরী, কাতার   |   শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২

কাতারের ঈর্ষণীয় পরিবর্তনের অজানা গল্প

বদলে গেছে কাতার। কিন্তু কীভাবে বদলালো ছোট্ট এই দেশটি। যার সঙ্গে শুধু আমেরিকার হাওয়াই-এর তুলনা করা যায়। জনসংখ্যা মাত্র ২৯ লাখ। এরমধ্যে বেশির ভাগই বিদেশি। আগে রাজধানী ছিল আল বিদা। এখন হয়েছে দোহা। কাতারের এই অবিস্মরণীয় পরিবর্তন নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে। জানার চেষ্টা করা হচ্ছে- কারা এই বদলানোর কারিগর। রয়েছে এন্তার রহস্য।

শুধু কি টাকা কোনো দেশকে বদলাতে পারে? আসলে এর জন্য দরকার সুচিন্তিত পরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনার পেছনে কারা? শুধু কি বিদেশি পরিকল্পনাবিদরা এর পেছনে কাজ করেছেন? এর উত্তর খুঁজেছি। একবাক্যে সবাই কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির কথাই বলছেন। বৃটিশ Royal Military Academy Sandhurst-এর গ্র্যাজুয়েট ধীর স্থির এই মানুষটি সিদ্ধান্ত নেন হিসেব-নিকেশ করে।

তার সুযোগ্য, দক্ষ নেতৃত্বই কাতরের এই আমূল পরিবর্তনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তেল আর গ্যাস সমৃদ্ধ মরুভূমির এই দেশটি হঠাৎ কেন আলোচনায়। অবকাঠামো পরিবর্তনে যুগান্তকারী, বিস্ময়কর যতসব পদক্ষেপ। বড় বড় দালানকোঠা ঘটা করে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। কাতারে আসলে এক বিপ্লব হয়ে গেছে। যে বিপ্লব মানুষের মধ্যে কৌতূহল তৈরি করেছে। লাখ লাখ বিদেশি ফুটবল ফ্যানরাও কাতার পৌঁছে অবাক হয়েছেন চোখ ধাঁধানো পরিবর্তন দেখে। বিশ্বকাপ ফুটবলের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। কে হবেন কাতার বিশ্বকাপের মহানায়ক। এতোসবের মধ্যেও বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন নিয়ে আলোচনা থামেনি। কীভাবে বালুর নিচে আধুনিক মেট্রোরেলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলো। কীভাবেই বা হলো পৃথিবীর অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম। এরমধ্যে এয়ারপোর্ট তো রয়েছেই। হাইওয়ের কথা আর কী বলবো! যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে এরকম পরিবর্তন আনা যেতে পারে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। কাতারা সাংস্কৃতিক গ্রাম এক অনন্য আবিষ্কার। আর এডুকেশন সিটির কথা উল্লেখ করতেই হয়। যেখানে পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এর পেছনে কাজ করেছে কাতারের সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লিগ্যাসি। এই কমিটি কাতারে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কমিউনিটির মতামত ও সহযোগিতা নিয়েছে। যে কমিটির কাজই ছিল কাতারকে বদলাতে হবে। কীভাবে বদলানো যায় তার জন্য শুরু থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পরিকল্পনাবিদ, বিশেষজ্ঞ, স্থপতিদের একত্রিত করা হয়। নেয়া হয় তাদের পরামর্শ। কোনো পাবলিসিটি ছিল না। কেউ টেরই পায়নি কবে, কোন কাজ শেষ হয়েছে, কোনটা হয়নি। কোনো লুটপাটের খবরও ছিল না। এটাই না-কি কাতারের নেতৃত্বের বিউটি।

ইমার্জেন্স অব কাতার গ্রন্থের লেখক ড. হাবিবুর রহমান এটাকে যুগান্তকারী বলে বর্ণনা করলেন। বললেন- টাকায় নয়, বুদ্ধিতে কাতার বিশ্বের সামনে এক মডেল। মনে রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট এই দেশটি ডিপ্লোম্যাসিতেও এগিয়ে। আর এটা হচ্ছে নীরব কূটনীতির ফসল। লেবানন, প্যালেস্টাইন এবং সর্বশেষ আফগানিস্তান সংকটের সমাধানে কাতারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ড. হাবিব ১৯৮২ সন থেকেই কাতার সরকারের একজন বিশেষজ্ঞ, ইতিহাসবিদ। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে তার বাড়ি। বিলেতের সোয়াস ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে ডক্টরেট করেছেন। কিছুদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে অধ্যাপনা তাকে আকৃষ্ট করেনি। বললেন, গবেষণার মধ্যেই আমি নিজেকে খুঁজে পাই। ড. হাবিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি গবেষণা করে কাতারের জন্মদিনের সঠিক তথ্য খুঁজে বের করেছে। আগে ৩রা সেপ্টেম্বর জাতীয় দিবস পালন করা হতো। গবেষণায় উঠে এসেছে ৩রা সেপ্টেম্বর নয়, এটা আসলে ১৮ই ডিসেম্বর। ২০০৭ সন থেকে ১৮ই ডিসেম্বরই জাতীয় দিবস পালন করা হচ্ছে। পেছনের ইতিহাস হচ্ছে, দেশটি ১৯৭১ সনে স্বাধীন হয়নি। ১৮৭৮ সন থেকেই তারা স্বাধীন ছিল। তবে তারা এই সময় বৃটিশদের সঙ্গে এক ‘protectorate (রক্ষাকারী)’ চুক্তির অধীনে ছিল। ১৯৭১ সনের ৩রা সেপ্টেম্বর এই চুক্তির সমাপ্তি ঘটে।

কাতার পুনর্গঠনে বেশ কিছু বাংলাদেশির ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর মধ্যে রয়েছেন খন্দকার রহমান বাবু। তিনি একজন কৌশলগত পরিবেশ পরিকল্পনাবিদ। একজন পরামর্শদাতা। তার বাড়ি ফরিদপুর। টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এসব বিবেচনায় নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে থাকেন। বর্তমানে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু তিনি কীভাবে জড়ালেন কাতার পুনর্গঠন মহা-পরিকল্পনায়? ২০০৯ সনে কাতার সরকারের তরফে তিনি ডাক পান। জাতীয় মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় তাকে। তিনি মূলত পরিবেশের দিকটাই দেখছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পঞ্চাশ থেকে ষাটজন নগর পরিকল্পনাবিদ তার সঙ্গে যোগ দেন।

অতিসম্প্রতি মানবজমিন তার মুখোমুখি হয়। জানার চেষ্টা করা হয়, কীভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন সামনে রেখে এই মহাকর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করা হলো। তিনি বলেন, দীর্ঘ ইতিহাস। সোজা কথায় যদি বলি, এটা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। সত্যি কথা কি- আমি চিন্তিত ছিলাম। ভাবছিলাম, বালুর নিচে তো শুধু পানি আর পানি। এই পানির মধ্যে স্টেডিয়ামই বা হবে কীভাবে, মেট্রোরেলই বা কীভাবে হবে। রাস্তাঘাট তৈরি করাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যখন মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু হলো তখন পানি দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছে মাত্র। তখনো কাতার আয়োজক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। এটা কীভাবে পাওয়া যেতে পারে তার প্রাথমিক প্রস্তুতি। বিড করতে হবে, ফিফাকে কনভিন্স করতে হবে। ফিফা তখন শর্ত দেয়- ৯৬টি ট্রেনিংগ্রাউন্ড তৈরি করতে হবে। কিন্তু কাতারে তো এতো জায়গা নেই। যে কয়টা গ্রাউন্ড আছে সেগুলো দিয়ে কোনোমতেই সম্ভব নয়।

তখন খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম ছাড়া ফিফার মান অনুযায়ী আর কোনো উল্লেখ করার মতো স্টেডিয়াম ছিল না। এশিয়ান গেমস হয়েছিল এই স্টেডিয়ামে। ফিফাকে জানানো হলো, ৫০টি ট্রেনিংগ্রাউন্ড তৈরি করা সম্ভব এবং তাই করা হলো। মাটির নিচে পাইলিং ছিল মস্তবড় চ্যালেঞ্জ। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা দিনরাত শুধু গবেষণাই করেছেন।

কাতার পুনর্গঠনে অনেকগুলো কমিটি কাজ করেছে। খন্দকার রহমান বাবু Ministry of Municipality and Urban Planning and Environment এর অধীনে গঠিত কমিটিতে কাজ করেছেন। তিনি এই কমিটির টেকনিক্যাল হেড ছিলেন। তিনি বলেন, মূলত কাজ করেছে জাতীয় কমিটি। আমরা পরিকল্পনাবিদরা সহযোগিতা করেছি মাত্র। বাংলাদেশি খন্দকার রহমান বাবু এই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা অনেকেই জানেন না। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই ভালোবাসেন। তিনি বলেন, ফিফা যখন সবুজ সংকেত দিল তখন তো পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। বারো বছরে সব কাজ শেষ করতে হবে। কাতারের নেতৃত্ব শুধু সাহস যুগিয়েছেন। যেখানে যেটা প্রয়োজন, তার যোগান দিয়েছেন। সুযোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া এ ধরনের কাজ সম্পন্ন করা যায় না। কাতার পুনর্গঠন তারই প্রমাণ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারলাম না। সাড়ে এগার বছর পর তিনি ফিরে গেছেন তার দ্বিতীয় আবাসভূমি অস্ট্রেলিয়ায়। বাংলাদেশি আরও কয়েকজন স্থপতির অবদানও স্মরণ করলেন তিনি যারা বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেছেন।

ইতিহাসবিদ ড. হাবিব বললেন, কাতার অত্যন্ত সেকুলার একটি দেশ। এখানে মুসলিম, হিন্দু বৌদ্ধ, খৃষ্টান একসঙ্গে বসবাস করেন। পৃথিবীর খুব কম দেশেই এত শান্তিপূর্ণ অবস্থান দেখা যায়।

Comments

comments

Posted ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২

dbncox.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

দশ বছর পর
দশ বছর পর

(1549 বার পঠিত)

সেই মা সেই ছবি
সেই মা সেই ছবি

(1168 বার পঠিত)

(1146 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

প্রকাশক
তাহা ইয়াহিয়া
সম্পাদক
মোঃ আয়ুবুল ইসলাম
প্রধান কার্যালয়
প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত এবং দেশবিদেশ অফসেট প্রিন্টার্স, শহীদ সরণী (শহীদ মিনারের বিপরীতে) কক্সবাজার থেকে মুদ্রিত
ফোন ও ফ্যাক্স
০৩৪১-৬৪১৮৮
বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন
01870-646060
Email
ajkerdeshbidesh@yahoo.com