দেশবিদেশ অনলাইন ডেস্ক | বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন ২০১৮
হলি আর্টিজান হামলা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী এক সপ্তাহ বা দশ দিনের মধ্যে মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।
বৃহস্পতিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলে তিনি। কমিশনার বলেন, ‘আগামী এক সপ্তাহ বা দশ দিনের মধ্যে আমাদের অভিজ্ঞ ও তরুণ কাউন্টার টেরোরিজমের অফিসাররা নিরবিচ্ছন্নভাবে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তদন্ত করেছে। তদন্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে আছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বা দশদিনের মধ্যে এই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করতে পারব।’
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে ২ পুলিশ সদস্য, ১৭ বিদেশি নাগরিক ও তিন বাংলাদেশি নিহত হন।
ঘটনার প্রায় দুই বছর পর চার্জশিট দাখিল প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার বলেন, দায়সারা গোছের অভিযোগ পত্র দিলে আসামিপক্ষের উকিলরা যখন বিভিন্ন প্রশ্ন করবেন তখন সেগুলোর উত্তর আমাদের দিতে হবে। প্রমাণ দিতে হবে। আমাদের মুখের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তার অকাট্য প্রমাণ এক্সপার্ট অপিনিয়ন দিয়ে আমাদের বলতে হবে। অস্ত্র অমুক দিয়েছে, অর্থ অমুক দিয়েছে, ষড়যন্ত্র অমুক করেছে সেটা কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না। এটা তথ্য প্রমাণ দিয়ে আমাদের প্রমাণ করতে হবে। এই কারণেই তদন্ত অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে করেছি। শেষ পর্যায়ে আছে। বিচারাধীন একটা বিষয়। আদালত ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তাকে কোনও নির্দেশনা দেওয়া যায় না, ফাঁসও করা যায় না। এতে তথ্য প্রমাণ নষ্ট হওয়ার মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীরা ছাড়া পেতে পারে। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে, ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। সেজন্য ৭-১০ দিনের মধ্যে জানতে পারবেন কাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। কারা অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে। সেখানে অনেকেই এনকাউন্টারে মারা গেছে। বিভিন্ন পর্যায়ে যারা জড়িত ছিল তাদের অনেকেই আমাদের চলমান জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে। অনেকে আমাদের কাছে গ্রেফতার আছে এবং দুয়েকজন পলাতক আছে। আপনার দ্রুতই সব জেনে যাবেন। যেহেতু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে তাই নামগুলো বলা সমীচীন হবে না।
নিরীহ বা শুধুমাত্র সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে কাউকে হয়রানি করা হবে না উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রধান বলেন, সকলকে বিনীতভাবে জানাতে চাই, এই মামলাটি আমরা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করেছি। আমরা বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়েছি। প্রযুক্তির সহযোগিতা ও এক্সপার্ট অপিনিয়ন নিয়ে অভিযোগটি দাখিল করা হচ্ছে। যাতে কোনও অপরাধী ছাড়া না পায়। ভবিষ্যতের জন্য যাতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে সে ব্যবস্থাই করা হচ্ছে। দেশে এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে। এ মামলায় নিরীহ লোককে সন্দেহ ও আন্দাজ করে কাউকে হয়রানি করা হবে না।
তদন্তের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, হলি আর্টিজানে হামলায় সমগ্র বাঙালি জাতি ব্যথিত। এ হামলা জাতির কপালে কলঙ্ক চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। এরপর থেকে এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল বা অভিযানে ছিল বা বিভিন্ন পর্যায়ে যারা সংশ্লিষ্ট ছিল তাদের সকলকে চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ মামলায় কাউন্টার টেরোজিমের তদন্ত কর্মকর্তারা অনেক তথ্য পেয়েছেন। সে তথ্য হলো হঠাৎ করেই হত্যাকাণ্ড ঘটেনি।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, এই হামলার জন্য প্রথম ছিল একটা পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার কারা পার্ট ছিল সেটাও আমাদের চিহ্নিত করতে হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। এই অস্ত্র সংগ্রহের প্রক্রিয়ার সঙ্গে কারা সম্পৃক্ত ছিল। কোথায় থেকে এসেছে , কোথায় জমা হয়েছে সেটা জানতে হয়েছে। অভিযান পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। সে অর্থ কারা দিয়েছে, কোথা থেকে এ সেছে, কিভাবে ট্রান্সফার হয়েছে? শেলটার দরকার ছিল। কারা সেটা দিয়েছে? কো-অর্ডিনেট কে বা কারা করেছে। এ মামলার জন্য এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার ও এক্সিটের জন্য অন্য আরেকটি গ্রুপ কাজ করেছে। তারা কারা—সব জানতে হয়েছে। এটা পরিকল্পিত একটি কাজ। গভীর ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের মামলাটি এতটাই ব্যাপক ও এত মানুষের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে যে তাদের চিহ্নিত করা, কার কী দায়িত্ব ছিল সেটা চিহ্নিত করা , প্রমাণ সংগ্রহ করা, বিভিন্ন কেমিক্যাল রিপোর্ট সংগ্রহ করা,এক্সপার্ট অপিনিয়ন সংগ্রহ করা—এটা একটি জটিল প্রক্রিয়া ছিল।
আমাদের অভিজ্ঞ ও তরুণ কাউন্টার টেরোরিজমের অফিসাররা নিরবিচ্ছন্নভাবে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তদন্ত করেছে। তদন্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে আছে।
এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কারা কী অর্জন করতে চেয়েছিল এমন প্রশ্নে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে জড়িতদের উদ্দেশ্য আদর্শ এক। আমরা এদের রুট খুঁজতে গিয়ে দেখেছি সব একই জায়গার। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিশ্বাস করে না। যারা ৭১ এ আমাদের মুক্তিযোদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, যারা আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিশ্বাস করে না,যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন সহ্য করতে পারে না— এদের সংশ্লিষ্টতা কোনও না কোনভাবে পাওয়া যায়।
হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গিবিরোধী অন্তত ৬০ টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে উল্লেখ করে কমিশনার বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ রুখে দিতে সক্ষম হয়েছি। প্রায় ৬০টির মতো ছোট-বড় অভিযানে জঙ্গিরা ধরা পড়েছে, নিহত হয়েছে, আমাদের লোকও আত্মোৎসর্গ করেছে। সারাবিশ্বে এধরনের উগ্রবাদ বিরোধী অভিযানে কখনই মানবিক আচরণ করা হয় না। আমরা অভিযানে অনেক ভিকটিমকে জীবিত উদ্ধার করেছি এবং তাদের সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। এটা বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে ভিন্ন ডাইমেনশন। আমাদের দেশের মানুষ জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, সন্ত্রাসকে পছন্দ করে না। জনগণের সহযোগিতা আমাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।’
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার বা হলি আর্টিজান হামলার পেছনে কোনও রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘এই পরিকল্পনার পেছনে অনেক লোক জড়িত ছিল। রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ততার কথা আমরা এই মুহুর্তে বলতে চাই না। বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর আপনারা ধাপে ধাপে পুরো বিষয়টা জানতে পারবেন। যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা, খণ্ডিত ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায় তারা বিভিন্ন নামে আত্মপ্রকাশ করলেও ঘুরেফিরে সবার উদ্দেশ্য এক। তারা শুধুমাত্র বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত। এর পিছনে রাজনৈতিক মতাদর্শ বা সমর্থন ছিল কিনা তা সময়সাপেক্ষ বিষয়। এ বিষয়টি আরও বিশ্লেষণের দরকার। বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর আপনারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে ধাপে ধাপে বিষয়গুলো জানতে পারবেন। প্রজাতন্ত্রের পেশাদার বাহিনী হিসেবে এ বিষয়ে আমাদের এখন কথা বলা সমীচীন হবে না।’
জঙ্গিবিরোধী অভিযান ঝিমিয়ে পড়েনি উল্লেখ করে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। ঝিমিয়ে পড়েনি। আমাদের কিছু কাজ আছে দৃশ্যমান যা আপনার দেখতে পান। কিছু কাজ আছে অদৃশ্য। আমরা অত্যন্ত সিরিয়াসলি কাজ করে যাচ্ছি। জনমতের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সারা জাতিকে জঙ্গি বিরোধী ঐকমত্য গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সারা জাতি আজ দল মত নির্বিশেষে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। বিভিন্ন স্কুল কলেজ সাধারণ মানুষের মাঝে জনমত গঠন করার কাজ আমাদের চলছে। প্রতিটি ইউনিভার্সিটিতে অপতৎপতা ঠেকাতে সার্ভিলেন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এখন সেই অপতৎপরতা বন্ধ রয়েছে। শিক্ষা ও ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমস্ত ধর্মের লোকদের নিয়ে জঙ্গিদের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা চলমান রয়েছে। চলমান থাকবে। এমন কিছু হঠাৎ করে হয় না, আবার হঠাৎ করে বন্ধ করা যায় না। এটা চলমান প্রক্রিয়া।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের জুলাই রাতে গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে ২ পুলিশ সদস্য, ১৭ বিদেশি নাগরিক ও তিন বাংলাদেশি নিহত হন। নিহত বিদেশিদের মধ্যে ৯ জন ইতালি, ৭ জন জাপানি ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি। এর মধ্যে একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। নিহত ৭ জাপানির মধ্যে ৬ জন মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত অপারেশন থান্ডার বোল্ট-এ পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। তারা হলো, মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনির্ভাসিটির ছাত্র নিবরাস ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার সাবেক ছাত্র মীর সামিহ মোবাশ্বের, বগুড়ার বিগিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র খায়রুল ইসলাম পায়েল, বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্র শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল। এছাড়া হলি আর্টিজানের কর্মচারী সাইফুল ইসলাম চৌকিদারও নিহত হয়।
এ হামলার ঘটনার পরে হামলার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ জঙ্গি নেতা তামিম চৌধুরী, মারজানসহ অনেকেই পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে অনেকে।
Posted ৬:২২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন ২০১৮
dbncox.com | ajker deshbidesh