দেশবিদেশ রিপোর্ট | মঙ্গলবার, ০৬ নভেম্বর ২০১৮
কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের ইয়াবা গডফাদাররা এখন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে নিজেদের দুষ্কর্ম ঢাকার চেষ্টা করছে অভিযোগ উঠেছে। গত রবিবার রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কওমী সনদের স্বীকৃতি উপলক্ষে আয়োজিত শোকরানা মাহফিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত টেকনাফের ইয়াবা গডফাদারদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
জানা গেছে, কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ছোট ভাই ও টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মৌলভী মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়া থেকে শতাধিক আলেমের একটি দল সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশে যোগ দেন। হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে শোকরানা মাহফিলে অংশগ্রহণকারী টেকনাফের আলেমদের ওই দলের নেতৃত্বদানকারী মৌলভী মুজিবুর রহমান সহ অন্তত তিনজন ছিলেন সীমান্তের তালিকাভূক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় জানান-‘উল্লিখিত ব্যক্তিরা ইয়াবা কারবারের তালিকাভুক্ত রয়েছেন। তারা পুলিশকে এড়িয়ে চলেন। এমনকি সীমান্তে যখন ইয়াবা বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয় তখন তাদের খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশটি ‘হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমী বাংলাদেশ’ এর ব্যানারে হলেও টেকনাফ থেকে অংশগ্রহণকারীরা সেখানে যোগ দেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে । সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ থেকে অংশগ্রণকারী দলের মূল নেতৃত্বে ছিলেন এমপি বদির ছোট ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি মৌলভী মুজিবুর রহমান। তিনি ছাড়াও শোকরানা মাহফিলে সীমান্তের আরও বেশ ক’জন ইয়াবা কারবারি ব্যানারের সামনের সারিতে ছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি মৌলভী মোঃ রফিক এবং টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও তালিকাভুক্ত মৌলভী আজিজ আহমদ সহ অরো অনেকেই।
উল্লেখিত ব্যক্তিদের মধ্যে মৌলভী মুজিব ও মৌলভী রফিক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের করা সর্বশেষ ৭৩ জনের ইয়াবা তালিকায় নাম রয়েছে এ দুই জনের। টেকনাফ সীমান্তের ইয়াবা কারবারের একটি বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন তারা-এমনই অভিযোগ রয়েছে। হেফাজতের ব্যানারের সামনের সারির নেতৃত্ববৃন্দের মধ্যে মুফতি জাফর সহ আরো অন্যান্যরা ছিলেন।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি মৌলভী রফিক আহমদ গতকাল সন্ধ্যায় জানান-তিনি তখনও পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার অপর ভাই এবং টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি মৌলভী আজিজ আহমদও সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে গিয়েছিলেন। মৌলভী রফিক জানান, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন এমপি বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান। এমপি বদি এবং মৌলভী মুজিব মিলে ২টি এসি বাস ভাড়া করে দেন এবং তারা সবাই মিলে আরো একটি সহ মোট তিনটি বাস নিয়ে উখিয়া ও টেকনাফ থেকে তারা সমাবেশে যোগদান করেন। অপরদিকে মৌলভী আজিজ আহমদ জানান, এমপি বদির ছোট ভাই তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি মৌলভী মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তারা ঢাকার সমাবেশে যোগদান করেন। তবে তারা ইয়াবা কারবারের সাথে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
স্থানীয়রা জানায়, শোকরানা মাহফিলে টেকনাফ থেকে নেতৃত্বদানকারী ৫ জনই টেকনাফ সীমান্তের ইয়াবা কারবারের বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রন করেন। তাদের নিয়ন্ত্রিত ইয়াবা সিন্ডিকেটটি সীমান্তের মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও বিপথগামী আলেমদের নিয়ে পরিচালিত। এই সিন্ডিকেটের মূল নেতৃত্বে থাকেন মৌলভী মুজিব। ইতোমধ্যে মৌলভী মুজিবের নেতৃত্বে টেকনাফ সীমান্তের ইয়াবা সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। এর আগের তাদের সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা শাহপরীর দ্বীপের হাফেজ আরমান ইয়াবার বড় একটি চালানসহ পুলিশের হাতে এবং হাফেজ শহীদুল্লাহ ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক হন। টেকনাফে মৌলভী মুজিবের ইয়াবা সিন্ডিকেটে অন্তত বিশ জন ব্যক্তি রয়েছেন যারা সরাসরি সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে ইয়াবা পাচার, চালান খালাস ও ইয়াবা কারবারের সাথে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফের এক মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন, মৌলভী মুজিব ক্ষমতার অপব্যবহার করে, উপজেলার সকল কওমী শিক্ষার্থী এবং আলেমদের তার কতৃত্বে রাখার চেষ্টা করেন। একতো তিনি তার ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিদের মাধ্যমে ইয়াবা কারবার করেন , অন্যদিকে উপজেলার বিভিন্ন মাদ্রাসায় তার পছন্দের লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ এবং অপছন্দের লোকদের চাকুরী থেকে বিতাড়িত করার মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এমনকি প্রায় মাদ্রাসায় মুহতামিম (পরিচালক) পদটিও মৌলভী মুজিব ঠিক করে দেন কাকে বসাতে বা সরাতে হবে। সাংসদ বদির ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি সব ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
সীমান্তে মৌলভী মুজিবের ঘনিষ্ট সহচর হিসেবে পচিচিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ইয়াবা কারবারির তালিকায় রয়েছেন টেকনাফ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান করা তালিকায় মৌলভী মোঃ রফিক। তার ভাই বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মৌলভী আজিকের নামও আছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রলালয়ের তালিকায়। তারা দুই ভাই মৌলভী মুজিবের ডান-বাম হিসেবে পরিচিত। এছাড়া দুই ভাই এলাকার শীর্ষ ইয়াবা কারবারি এবং মৌলভী মুজিবের ইয়াবা সিন্ডিকেটের অন্যতম নিয়ন্ত্রক। এছাড়া গত রোববারে টেকনাফ থেকে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ঢাকার মাহফিলে মৌলভী মুজিবের সাথে টেকনাফের সদর ইউনিয়নের উত্তর লম্বরি গ্রামের মুফতি মৌলভী জাফর আহমদ সহ আরো বেশ ক’জন মওলানা ছিলেন। এদের মধ্যে মুফতি জাফর কক্সবাজার শহরে একবার আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ আটক হয়েছিলেন। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যরা তার মাথার পাগড়ি থেকে ইয়াবার চালান আটক করেছিল।
টেকনাফের প্রাচীনতম ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হ্নীলা দারুসসুন্নাহ মাদ্রাসার এক সিনিয়র শিক্ষক বলেন, ‘মৌলভী মুজিবসহ যারা হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে শোকরানা মাহফিরে যোগদান করেছিলেন তারা আগে কখনো হেফাজতের সাথে জড়িত ছিল বলে আমাদের জানা নেই, হেফাজত যখন একসময় সরকারের বিরুদ্ধে ছিল তারা তখন হেফাজত থেকে দূরত্বে ছিলেন, এখন যখন হেফাজতের সাথে সরকারের সম্পর্ক ভালো তখন তারা হেফাজতের সাইনবোর্ড ব্যবহার করছেন। তারা কখন কোন দল করবেন মূলত তারা নিজেরাই জানেননা, অপকর্ম আড়াল করতে এবং সুবিধাভোগ করতে যখন যে দল দরকার তারা সে দলেই অন্তর্ভূক্ত হন।’
এদিকে সীমান্তের বাসিন্দারা জানান, সরকারের মাদক বিরোধী অভিযানের মধ্যেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের তালিকাভূক্ত ইয়াবা কারবারি মৌলভী মুজিব এবং তার সহযোগি তালিকাভূক্ত ইয়াবা কারবারিরা ও সিন্ডিকেট হোতারা এখনো এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারা এলাকায় থাকলেও তাদের ধরতে এখনো আইনশৃংখলা বাহিনী এ পর্যন্ত কোন অভিযান পরিচালনা করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই ইয়াবা কারবারি সিন্ডিকেটের এসব রাঘববোয়ালদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে শুধু চুনোপুটিদের ধরলে ইয়াবা বন্ধ হবেনা বলে মত দেন তারা। #####
Posted ১২:৫০ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৬ নভেম্বর ২০১৮
dbncox.com | ajker deshbidesh