শফিক আজাদ, উখিয়া | রবিবার, ২৬ আগস্ট ২০১৮
২০১৭ সালের ২৫ আগষ্টের পর মিয়ানমার সেনা,বিজিপি, নাটালা ও রাখাইন উগ্রবাদিদের চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে এদেশে পালিয়ে আসা ১১লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি অস্থায়ী শিবিরে পলিথিনের ঝুপড়িতে অনিশ্চিত বসবাস করছে। রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের ১বছর পার হয়ে গেলেও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কুটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে সময় ক্ষেপন করছে। উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধাদি গ্রহন করে থাকলেও এভাবে অনিশ্চিত ভাসমান অবস্থায় তারা দীর্ঘদিন এখানে থাকতে চান না। শুক্রবার কুতুপালং লম্বাশিয়া, মধুরছড়া, বালুখালী, ময়নারঘোনা, তাজনিমারখোলা ও শফিউল্লাহকাটা আশ্রয় শিবির ঘুরে সেখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত বছরের ২৫ আগষ্ট আজকের এই দিনে সেখানকার (আরসা) নামক বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সংগঠন প্রায় ৩০টি সেনা চাউনিতে হামলার ঘটনার অজুহাত তুলে মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর নানান নির্যাতন শুরু করে বর্মী বাহিনীরা। বর্মী সেনা,বিজিপি ও উগ্রবাদী রাখাইন যুবকেরা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা নর-নারি, শিশুর উপর বর্বরোচিত নৃশংসতা শুরু করে। বর্তমানে নতুন পুরাতন মিলে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ১১লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭ জন রোহিঙ্গা রয়েছে বলে (রোহিঙ্গা নিবন্ধনে নিয়োজিত) বাংলাদেশ পার্সপোর্ট এন্ড ইমিগ্রেশন অধিদপÍর সুত্রে জানা গেছে। চলতি বছরের ২৫ আগষ্ট রোহিঙ্গা নির্যাতনের ১বছর পূর্ণ হলেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সুনিদিষ্ট কোন প্রস্তাব নেই দাবী করে রোহিঙ্গা হামিদ হোসেন, আবু তাহের, আবুল ফয়েজ, ডাঃ জাফর আলম নামের বেশ কয়েক জন শিক্ষিত রোহিঙ্গা জানায়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আটকে থাকার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করে মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে অং সান সূ চি যে বক্তব্য দিয়েছেন-তাতে হতাশ হয়েছেন তারা।
তারা এই বক্তব্যের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে যে মহানুভবতা দেখিয়েছে তা বিশ্বে বিরল। যার কারনে আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তারা বলেন, মিয়ানমার সরকার মূলত: প্রত্যাবাসন নিয়ে তালবাহানা করছে, আদৌ রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কোন উদ্যোগ গ্রহন করেননি মিয়ানমার। সংবাদ সংস্থা বিবিসি বাংলার উদ্বৃতি দিয়ে এসব রোহিঙ্গরা বলেন, গত বছরের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হয়। এরপর দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকদফা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু চুক্তি সইয়ের পর ১০ মাসেও সেই চুক্তির প্রধান কোনো শর্তই মিয়ানমার বাস্তবায়ন করেনি। মুল সমঝোতা চুক্তিতে পরিস্কারভাবে বলা আছে, রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসিত হবে তাদের স্বস্ব নিজেদের গ্রামে। সম্ভব হলে স্বগৃহে। এবং কোনো কারণে যদি সেটি সম্ভব না হয়, তাহলে তাদের এমন স্থানে নিতে হবে, যেটি তাদের গ্রামের নিকটবর্তী। কিন্তু মিয়ানমার শুধু দুটি অভ্যর্থনা ক্যাম্প এবং একটি ট্রানজিট ক্যাম্প ছাড়া আর কোন চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। জমিজমা বা নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিশ্চিত না করে তারা ফিরে গেলে আবারও নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে বলে তারা মনে করেন। রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনাই তারা করেনি। বিশ্বকে দেখানোর জন্য নাটক করছে মিয়ানমার সরকার।
তারা আরো জানান, ইতিপূর্বে জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিশে^র সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যক্তিরা রোহিঙ্গাদের লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা সরাসরি শুনেছেন এবং প্রত্যক্ষ করেছেন। আর্ন্তজাতিক বর্হিবিশে^র চাপের মূখে কিছুটা মিয়ানমার সরকার নমনীয় হলেও বিভিন্ন অজুহাত তুলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঝুলিয়ে রেখেছে। সর্বশেষ গত ১১ এপ্রিল মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ,ত্রাণ ও পুর্নবাসনমন্ত্রী ড. উইন মিয়ান আয়ে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন এবং রোহিঙ্গা নারী,পুরুষ,শিশুদের সাথে একান্তে আলাপ করেন। এসময় মিয়ানমারমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আহবান জানালেও কিন্তু কিভাবে, কখন সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাবনা না থাকায় হতাশ রোহিঙ্গারা। বিবিসি বাংলা সুত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সূ চি সিঙ্গাপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মিয়ানমার শরণার্থীদের নিতে প্রস্তুত, তাদের পুনর্বাসনের জন্য জায়গাও ঠিক হয়েছে। কিন্তু তাদের পাঠানোর দায়িত্ব মূলত বাংলাদেশের। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে অং সান সূ চি-র এমন বক্তব্যকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়রে ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা। বিবিসি বাংলা’কে দেওয়া বক্তব্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেছেন, মিয়ানমারের নেত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
যেটা আসলে বাস্তব অবস্থা থেকে শত যোজন দূরে, এধরণের মন্তব্য সত্যিই খুব বিস্ময়কর এবং খুবই হতাশাজনক বটে। বাংলাদেশ পার্সপোর্ট এন্ড ইমিগ্রেশনে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু নোমান মুহাম্মদ জাকের হোসেন জানিয়েছেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন-পুরাতন মিলে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭ রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। নিবন্ধিত ওই সব রোহিঙ্গাদের আইডি কার্ড দেওয়া হয়েছে, যাতে ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহন করতে রোহিঙ্গাদের ঝামেলা পোহাতে না হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, সর্বশেষ ১৬ ফেব্রুয়ারী দু’দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ৬৭৩ পরিবারে ৮০৩২জন রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করেছে। মিয়ানমার ওই তালিকা যাছাই-বাছাই করে ৩৭৪জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হলেও কখন,কিভাবে প্রত্যাবাসন শুরু করা হবে তার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রকাশ করেনি এখনো।
যার একমাত্র কারণ হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, এদেশে রোহিঙ্গা আসার আজ ১বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু যে ভাবে সরকার আগ্রহ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য দেশ বিদেশে ঘুরে ফিরেছে তাতে এতদিনে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে কতিপয় এনজিও সংস্থার কর্তা ব্যক্তিরা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে না ফেরার জন্য ইন্ধন যোগাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ বিদেশ থেকে আসা কোটি কোটি টাকা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। এ জন্য ওই সব এনজিওরা রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখার জন্য তৎপর। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত করা যাচ্ছে।
মিয়ানমার সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি:
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবস্থা জারি করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি’র (আরসা) হামলার প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে এ ব্যবস্থা নিয়েছে তারা। নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত বরাবর বসিয়েছে ১৬০টিরও বেশি পুলিশ আউটপোস্ট। এ খবর দিয়েছে মিয়ানমারের অনলাইন ইরাবতী। উল্লেখ্য, গত বছর ২৫ শে আগস্ট মংডু, বুচিডং ও রাশিডংয়ে ৩০টি পুলিশ আউটপোস্টে হামলা চালায় আরসা। আর এর জের ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর চালায় নৃশংস নির্যাতন। ওই হামলার প্রথম বার্ষিকী ২৫ শে আগস্ট শনিবার। আরসার ওই হামলায় এক ডজনেরও বেশি নিরাপত্তারক্ষী ও সরকারি কর্মচারী নিহত হন। এমনটা দাবি করে রাষ্ট্রীয় মিডিয়া। তাদের হিসেবে পরের মাসেই বেসামরিক মিলে নিহতের সংখ্যা ৮০র বেশি বলে স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ। আরসাকে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের নিন্দা জানায় সরকার। রাখাইন রাজ্য পুলিশের কর্নেল অং মায়াত মোই ইরাবতীকেক বলেছেন, শরণার্থীদের রূপ ধরে আরসা সীমান্ত বরাবর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। সে জন্য সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ১৬০ টিরও বেশি পুলিশ আউটপোস্টে মোতায়েন করা হয়েছে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্য।
গত বছর আরসার হামলার জবাবে সেনাবাহিনী যে অভিযান চালায় তাতে আরাকানিজ, থেট এবং ডাইংনেট সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষ পালাতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের হিসাব মতে, প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে রোহিঙ্গাদের এত বিপুল সংখ্যাকে অস্বীকার করে মিয়ানমার সরকার। এরপর ওই এলাকায় স্থিতিশীলতা পুনর্বহাল করা হয়েছে। কিন্তু মংডুর সব সম্প্রদায়ই এখনও এক আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। এক বছর পেরিয়ে গেলেও তারা আক্রমণের শিকার হতে পারেন, যেমনটা হয়েছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরের হামলার পরে।
সরজমিন সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু কোনারপাড়া ঘুরে দেখা যায়, সীমান্তে কাটাতাঁর ঘেষে অবস্থান নিয়েছে মিয়ানমার সেনারা। হঠাৎ সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা উপস্থিতির কারনে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রয়েছে সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রিত ৫ হাজার রোহিঙ্গা ও সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয়রা। স্থানীয় ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান একে জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তে অতিরিক্ত মিয়ানমার সেনা টহলের কারনে নোম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রিত রোহিঙ্গার পাশাপাশি ঘুমধুমের জনসাধারণ উৎকণ্ঠায় রয়েছে। নোম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রিত রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, অতিথের চেয়ে অতিরিক্ত সেনা,বিজিপি টহল জোরদার করেছে মিয়ানমার। এসব সেনা ও বিজিপি সদস্যরা শূণ্যরেখায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন হুমকি-ধমকি প্রদর্শন করছে। যার ফলে নিঘূম রাত কাটাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
দেশবিদেশ /২৬ আগস্ট ২০১৮/নেছার
Posted ২:৩১ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৬ আগস্ট ২০১৮
dbncox.com | ajker deshbidesh