জাকারিয়া আলফাজ , টেকনাফ | মঙ্গলবার, ১৯ জুন ২০১৮
ভাসমান জীবনে পরবাসে শরণার্থী পরিচয়ে এটাই সম্ভবত রোহিঙ্গাদের প্রথম ঈদ পালন। এর আগে রোহিঙ্গারা খুশির ঈদ কাটিয়েছিল নিজ নিজ দেশে পরিবার পরিজনের সাথে। তবে পরদেশে শরণার্থী হিসেবে এটাই প্রথম ঈদ পালন ভিটেমাটিছাড়া অনেক রোহিঙ্গাদের। তাই তাদের ঈদ পালনে নতুন অনুভূতি, নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার শরণার্থী শিবির গুলোতে দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের ঈদ পালনের ভিন্ন দৃশ্য।
এবারের ঈদ রোহিঙ্গাদের কারো কারো মুখে যেমন আনন্দের হাঁসি ফুটিয়েছে, কেউ বা আবার স্বজন হারানোর শোকে কাতর হয়েছেন। তবে বড়দের ঈদ যেমনিই কাটুক, ছোটদের ঈদ কেটেছে খেলাধূলায়, উচ্ছ্বাস-উল্লাসে। আড্ডায় আর এঘর-ওঘর বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে কেটেছে রোহিঙ্গা নারীদের ঈদ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঈদের দিনে স্বজন হারানো পরিবার গুলোর মাঝে বিরাজ করছিল শোকের মাতম। ওপারে রাখাইনের সহিংসতায় মিয়ানমার সেনা ও মগদের হাতে নির্মম নির্যাতনের মুখে যারা স্বজন হারিয়েছিলেন, খুশির এই ঈদে তাদের ঘরে শুধুই কান্নার রুল।
স্বজন হারারা ঈদের নামাজ শেষ করে ঘরে ফিরে পরস্পরকে জড়িয়ে কেঁদেছেন, সবাই অঝোরে কেঁদেছেন। প্রিয়জন হারানোর শোক, জন্মভূমি ছাড়ার ব্যথা তাদের হৃদয় থেকে মুছেনি আজও। তাই ঈদ উৎসবের দিনেও সেই স্বজন হারানো রোহিঙ্গা পরিবারের মাঝে নেমেছিল স্বজন বিনে ঈদ পালনের শোক। তাদের অনেকের মাঝে ছিলনা কোন ঈদ আনন্দ কিংবা উৎসবের আমেজ। তবু স্বস্তি এটুকুই যে, শিবিরে তারা নিরাপদে ঈদ করছেন। বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ভাসমান রোহিঙ্গা জীবনে তাদের ঈদ কেমন কেটেছে। টেকনাফ উপজেলার লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত ৭ মাস আগে এসে ঠাঁই করে নিয়েছেন মংডুর হাচ্চুরতা গ্রামের জাহেদা বেগম (৬২)।
রাখাইনে তাদের জায়গা জমি , সহায় সম্পত্তিও ছিল যথেষ্ট। তবে ওপারের জমিদারি কোন কাজে আসেনি জাহেদার পরিবারে ।
সেনা ও মগরা তার পরিবারের ৭ সদস্যকে হত্যা করেছিল। প্রাণে বেঁচে যাওয়া ৪ সদস্য শেষমেষ রাখাইন ছাড়তে বাধ্য হয়ে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে নৌকায় চেপে পালিয়ে এসেছিলেন তারা। ভিনদেশে খুশির ঈদ ভালোমতে কাটেনি স্বজন হারা এই রোহিঙ্গা নারীর ঘরে। চোখের জল মুছতে মুছতে সেই কাহিনী বর্ণনা করছিলেন জাহেদা- “ রাখাইনে সহিংসতা শুরু হওয়ার মাস খানেক পরও আমরা সেখানে থেকে যেতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কয়েকদিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে আমরা নিরাপদে বসবাস করতে পারব। কিন্তু মিয়ানমার সেনারা রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়িয়ে দিল এবং রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করছিল। পরিস্থিতি কোনমতে স্বাভাবিকতায় ফিরছিলনা। একদিন মধ্য দুপুরে কেউ বাড়ির ভিতরে আবার কেউ বাইরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ সেনা এবং মগদের একটি দল এসে অতর্কিতে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা চারদিকে ঘরটি ঘিরে ফেলে এবং দরজাগুলো আটকে দেয় যাতে কেউ বেরুতে না পারে। তারপর তারা ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। শত্রুর দেয়া আগুনে দ্বিতলা কাঠের বাড়িটি দাউ দাউ করে জ্বলছিল।
ঘর থেকে বের হতে না পেরে সেদিন আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল আমার দুই নাতনী, তিন সন্তান, স্বামী ও পুত্র বধু। ” ওই রোহিঙ্গা নারী আরো বলেন, “ মগরা শুধু আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে এবং স্বজনদের হত্যা করে ক্ষান্ত হননি, তারা আমাদের ধরে দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতনও চালিয়েছিল। এরপর আমাদের তাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ আর কখনো এদিকে চোখ ফেরালে আমাদেরকেও নাকি মেরে ফেলবে ! তাই প্রাণের লোভে আমি দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে রাতেই দংখালী চর থেকে একটি নৌকায় চেপে বাংলাদেশে পালিয়ে আসি।” দেশের বাইরে প্রথম ঈদ করছেন, এরই মাঝে অনেক স্বজনকেও হারিয়েছেন ,ঈদের অনুভূতি কেমন লাগছে ? এমন প্রশ্ন করাতে অঝোরে শুধু কাঁদছেন আর চোখের জল মুছলেন জাহেদা। জাহেদার ভাষায়, “ আমাদের ঘরে ঈদ আসলে আরো দুঃখ বাড়ে, ছেলে , মেয়ে , নাতী, নাতনি যাদের পুড়িয়ে মেরেছে মিয়ানমার সেনা ও মগরা সেই স্বজনদের কথা বার বার মনে পড়ে, কান্না ধরে রাখতে পারিনা। কোনভাবে তাদের মৃত্যুদৃশ্য ভুলতে পারছিনা। এখনো কানে বাজে জলন্ত ঘরের ভিতর থেকে মা মা বলে বাঁচার তাগিদে সন্তানদের কান্নার আওয়াজ গুলো।
এই ঈদের দিনে তাদের জন্য আল্লাহর কাছে শুধু দোয়া করেছি।” রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির গুলোতে জাহেদার মতো আরো হাজারো রোহিঙ্গা রয়েছেন যারা হারানো স্বজনদের শোকে ঈদ কাটিয়েছেন চোখের অশ্রুতে। ঈদের দিনে তাদের মাঝে ছিলনা কোন আনন্দ , না কোন উৎসব- উল্লাস। উখিয়ার কতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আয়েশা বেগমের ঈদ কেটেছে ঠিক একই ভাবে। আয়েশাও স্বজন হারিয়েছিলেন, তবে মগদের দেয়া আগুনে বা গুলিতে নয়, অনিরাপদ মাতৃভূমি ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে সাগরে নৌকা ডুবিতে। রোহিঙ্গা নারী আয়েশা জানালেন, “ স্বামী দুই বছর আগে মিয়ানমারে মারা গিয়েছিল। চার কন্যা ও ২ পুত্র সন্তানকে নিয়ে রাখাইন ছেড়ে প্রতিবেশী আরো কয়েকজন মিলে একটি নৌকা ভাড়া করে পালিয়ে আসছিলাম। বাংলাদেশে পৌঁছতে হঠাৎ সাগরের বড় ঢেউয়ে পড়ে নৌাকাটি ডুবে গিয়েছিল।
আর সেই নৌকা ডুবিতে আমার ৩ কন্যা ও এক পুত্র সন্তান মারা যায়। আজ ঈদের দিনে আমার প্রিয় সন্তানদের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে, যাদের সাথে নিয়ে নিজেদের দেশে আমরা কত আনন্দে ঈদ করতাম। আমার সেই সন্তানরা আজ ঈদের দিনে আমার কাছে নেই।” অন্যদিকে রোহিঙ্গা শিবির গুলোতে বড়দের ঈদ যেভাবে কাটুক, ছোট রোহিঙ্গা শিশুদের ঈদ কেটেছে হেঁসে খেলে এবং উচ্ছাস উল্লাসে পরম আনন্দে। ঈদের আগে অনেক ব্যক্তি বা সংস্থা থেকে তারা নতুন জামা কাপড় পেয়েছেন। ঈদের আনন্দে রোহিঙ্গা শিশুরা এভাবে মেতেছিল যেন, তাদের কাছে এদেশ-ওদেশ কোন পরখই নেই। তাই তারা হেঁসে-খেলে , বাঁশি বাঁজিয়ে, আবার কেউ বেলুন ফাটিয়ে, কেউবা আবার দোলনায় চড়ে আনন্দে কাটিয়েছেন এবারের ঈদ। উখিয়া উপজেলার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের রোহিঙ্গা শিশু মোঃ রাসেল বলেন, “ আমরা নতুন জামা পরেছি, পাড়ার সব শিশুরা মিলে একসাথে ঘুরাঘুরি করেছি, ঈদের দিনগুলো আমাদের খুব ভাল লেগেছে।” রোহিঙ্গা শিবির গুলোর আবার কোথাও কোথাও দেখা গিয়েছে বৃদ্ধ বা প্রবীণদের ঈদ পালনে ভিন্নতা। তারা অনেকে বড় গাছের ছায়ায় বসে গল্প গুজব করছিলেন। কেউ আবার আড্ডায় কাটিয়ে দিয়েছেন ঈদের দিনটি।
Posted ১০:২৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৯ জুন ২০১৮
dbncox.com | ajker deshbidesh