মুফতি সোলাইমান কসেমী | সোমবার, ০৬ মে ২০১৯
রোযার উদ্দেশ্যে ভোর রাতে খাবারকে আরবীতে সুহর, সাহুরারা সাহার বলে। সেহরী শব্দটি হচ্ছে উর্দু যা পরে বাংলায় প্রচলিত হয়ে গেছে। সারাদিন রোযার উদ্দেশ্যে উপবাস থাকার জন্য শেষরাতে পানাহার জরুরী। এতে করে পানাহার থেকে বিরত থাকার জন্য পরিমান হ্রাসে করা হয়। শেষ রাতে না খেলে দীর্ঘ সময়ে ব্যবধানের কারণে শরীর অত্যধিক দূর্বল হয়ে পড়বে। রোযার মাধ্যমে মানুষকে দূর্বল করা আল্লাহ্র উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ যেহেতু দিনে পানাহার নিষিদ্ধ করেছেন তাই রাত্রে প্রয়োজনীয় খাবার খাওয়া খুবই যুক্তি সঙ্গত। রমযান মাসে প্রতিটি কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে পরিকল্পিত ভাবে নিয়ন্ত্রিত সেহরী গ্রহণ করা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শেষ রাতে পানাহার করতেন এবং সোবহে সাদেক থেকে রোযা রাখতেন। সেহরী খাওয়ার মধ্যে যথেষ্ট সওয়াব ও কল্যাণ রয়েছে। রয়েছে অনেক বরকত- হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ- অর্থ তোমরা শেষ রাতের খানা খাও তাতে বরকত আছে। (বুখারী) হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন-নিশ্চয় আল্লাহ ও ফেরেস্তারা সেহরী গ্রহণকারীর জন্য প্রার্থনা করেন (তাবারানী)। হযরত আমার বিন আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, আমাদের এবং আহলে কিতাবের মধ্যে পার্থক্য হলো সেহরী খাওয়া আর আমাদের তো প্রভাত উদয়ের আগ পর্যন্ত পানাহারের অনুমতি রয়েছে, (মুসলিম) উল্লেখ্য যে, রাত্রে শুয়ে পড়ার পর আহলে কিতাবের পানাহার নিষিদ্ধ ছিল। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা দিনে রোযার জন্য সেহরী খাবারের সাহাস্য নাই এবং রাতে নামাজের জন্য দুপুরে নিদ্রাবিহীন বিশ্রামে গ্রহণ কর। এই হাদীসে দিনে রোযা রাখার জন্য সেহরীর মাধ্যমে এবং রাত্রে তারাবীর ও তাহাজ্জুদের জন্য দুপুরের হালকা বিশ্রামের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দেরী করে সেহরী খাওয়া উত্তম। নবী (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তিনকাজ পছন্দ করেন, (১) দ্রুত ইফতার করা (২) দেরী করে সেহরী খাওয়া (৩) নামাযে এক হাতের উপর অন্য হাত রেখে দাঁড়ানো, (তবারানী)। অন্য এক রাসূল (সাঃ) বলেছেন, রাবী বলেন, আমি রাসূল (সাঃ) এর কাছ গিয়ে দেখি, তিনি শেষ রাতের খানা খাচ্ছেন, তারপর তিনি বললেন- একা বরকতময়, আল্লাহ তোমাদের তা দান করেছেন, তোমরা তা ত্যাগ করো না। (নাসাঈ) হযরত সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেছেন, তিন জিনিসে বরকত রয়েছে। সেগুলো হল, জামাআত সারীদ নামক খাবার এবং সেহেরী (তাবারানী) সেহরীর আরো ফজীলত বর্ণিত হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূর (সাঃ) বলেছেন- খাবার হালাল হলে তিন ব্যক্তির খানার কোন হিসেব নেয়া হবে না। ইনশাআল্লাহ ১। রোযাদার, ২। সেহরী বা শেষ রাতের খাবার গ্রহণকারী এবং ৩। আল্লাহ্র পথের মুজাহিদ বা সৈনিক, (বাযযার) সেহরী খাওয়ার সময়ঃ
্এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন-তোমরা যে পর্যন্ত পানাহার কর, যে পর্যন্ত না রাতের কালো রেখার বুক চিরে সোবহে সাদের বা প্রভাতের সাদা রেখা পরিস্কার ফুটে উঠে এবং রাত পর্যন্ত রোযা রাখ। (সূরা বাকারা-১৮৭) সেহেরীর শেষ সময় পর্যন্ত ওলামায়ে কেরামের মত পার্থক্য রয়েছে, কারো মতে প্রভাত বা সোবহে সাদেকের প্রাথমিক রেখা সুচিত হওয়ার সাথে সাথেই পানাহার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আবার কেউ মনে করেন, প্রভাতের সাদা রেখা উজ্জল হয়ে না উঠা পর্যন্ত পানাহারের সুযোগ থাকে, হানাফী ফকীহদের মধ্যে ও এ বিষয়ে মতবিরোধ আছে, ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে বলা হয়েছে, প্রথম মতটি সতর্কতামূলক আর দ্বিতীয় মতটি প্রশস্ত এবং সহজ। অধিকাংশ ওলামা দ্বিতীয় মতের সমর্থক। প্রথম মতের তুলনায় দ্বিতীয় মতে কয়েক মিনিট বেশী সময় পাওয়া যায়, নামাঈ শরীফে বর্ণিত এক হাদীসের ২য় মতটির উপর সমর্থন পাওয়া যায়, হযরত যায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আমরা হোজাইফাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূল (সাঃ) সাথে আপনি কোন সময় সেহরী খেতেন? তিনি বলেন, আমরা যখন সেহরী খেতাম তখন দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ত, কেবল সূর্য উঠার বাকী থাকত।
আবু দাউদ শরীফে আবু হোরায়রা (রাৎ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যদি তোমাদের কারো সেহরী খাওয়ার সময় আজানের আওয়াজ আসে সে যেন আহার ছেড়ে না দেয় এবং পেট ভরে আহার করে। হযরত বেলাল (রাঃ) রমযানে লোকদের কে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য সোবহে সাদেকের অর্থাৎ প্রভাত সূচনার আগে আজান দিতেন, আরো আজান দিতেন আবদুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম নামক জনৈক অন্ধ সাহাবী লোকেরা সোবহে সাদেক হয়েছে, বললে, তিনি আজান দিতেন। আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে তিনটি ব্যাখ্যা আছে, কেউ বলেছেন এই আজান মাগরিবের আজান, কেউ বলেছেন, ফজর সূচনার আজান, শাহ ওয়ালি উল্লাহ তাঁর হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা গ্রন্থে লিখেছেন, এটা হচ্ছে হযরত বেলালের আজান, কিন্তু হাদীসটিতে বর্ণিত পানাহার বিষয়ক আলোচনা তখনই অর্থবহ হতে পারে, যখন রোযাদারের নিজের কাছে ভোর হয়ে যাওয়ার মজবুত ধারণা সৃষ্টি না হবে। ঐ আজান যে প্রভাত বা সোবহে সাদিকের সূচনার আজান তা মুসনাদে আহমদে বর্ণিত অপর এক হাদীস দ্বারা বুঝা যায়। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তোমাদের কেউ যখন সেহরী খাওয়া অবস্থায় আজান শুনে তখন সে যেন খাওয়া শেষ করার আগে খাওয়ার পাত্র রেখে না দেয়। প্রভাত সূচিত হয়ে গেলে মোয়াজ্জিন ঐ আজান দিত। দুই হাদীসের রাবী এক হওয়ায় বুঝা যায় যে, শেষের হাদীসটি আগের হাদীসের ব্যাখ্যা এই হাদীস দ্বারা পরিস্কার হয়ে যায় যে, উপরোল্লিখিত আজান সেহরীর জন্য জাগানোর বেলালের আজান নয়, কারণ বেলাল তো লোকদেরকে সেহরী খাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য আজান দিতেন। ফলে তার আজানের সময় খাওয়া অবস্থায় থাকা এবং আজান শূনে তাড়াহুড়া করে খেয়ে নেয়ার অর্থহীন ব্যাপার। তাঁর আজানের পর লোকেরা ঘুম থেকে উঠে আস্তেদীরে সেহরী খেত। তাড়াহুড়া করে খাওয়ার প্রশ্ন তখন সৃষ্টি হয়, যখন খাওয়া শুরু করেছে এবং খাওয়া শেষ না হতেই দ্বিতীয় আজান পড়েছে। আজকাল লোকেরা কাড়াকড়ি শুরু করেছে। কিন্তু শরীয়ত এ দুটি বিষয়ে সময়ের ব্যাপারে এমন কোন সিমানা নির্ধারণ করে দেয়নি যে তার থেকে কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিট এদিক ওদিক হয়ে গেল রোযা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রভাতকালে রাত্রের বুক চিরে সাদা রেখা ফুটে ওঠার মধ্যে কিছু সময়ের অবকাশ আছে। ঠিক সোবহে সাদেকরা প্রভাতের উদয় মুহুর্তে যদি কারো ঘুম ভাংগে, তাহলে সঙ্গতভাবেই সে উঠে তাড়াহুড়া করে পিছু পানাহার করে নিতে পারে। (তোফহীমুল কোরান সূরা বাকারা-১৮৪)
ওলামায়ে কেরামের মতপার্থক্য উম্মার জন্য রহমত তা প্রয়োজনে যে কেউ ঐ সকল মত পার্থক্যের সুযোগ গ্রহণ করে কষ্ট থেকে বাঁচতে পারে। প্রভাতের সুর্যোদয় ও সুর্যস্তের সময়ে যে কিছু সময়ের অবকাশ আছে। তা আল্লাহরই করুন কোন মানুষের সংর্কীনতা বা কড়াকড়ি প্রদর্শনের প্রয়োজন নেই। নবী (সাঃ) বলেছেন, যে পর্যন্ত লোকেরা দ্রুত ও বিনা বিলম্বে ইফতার ও দেরী করে সেহরী খাবে, যে পর্যন্ত তারা কল্যাণের পথে থাকবে। এ দুটো হীদসে দেরীতে খাওয়াকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এটা বিজ্ঞান সম্মত, কেননা, সন্ধ্যা রাত্রে ইফতারের সময় হজমের জন্য সময় যত বেশী ততই ভাল। আল্লাহ আমাদের সকলকে উপরোক্ত হাদিস সমূহ আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
মুফতি সোলাইমান কসেমী
পেশ ইমাম, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, কক্সবাজার।
Posted ১১:২৮ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৬ মে ২০১৯
dbncox.com | ajker deshbidesh