শুক্রবার ১লা ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম
শিরোনাম

সামুদ্রিক শৈবাল চাষ, সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত

তারেকুর রহমান   |   সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সামুদ্রিক শৈবাল চাষ, সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত

পরিবেশের ক্ষতি না করে টেকসই উপায়ে সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারই হল ব্লু-ইকোনমি। সমুদ্র অর্থনীতি বা সুনীল অর্থনীতিতে সামুদ্রিক ও উপকূলের সব সম্পদই অন্তর্ভুক্ত। সমুদ্র গবেষণা এখন সময়ের দাবি। বিখ্যাত সমুদ্র বিজ্ঞানী গুন্টার পাওলি বলেছেন- দশ বছর সমুদ্র গবেষণার মাধ্যমে ১০০ উদ্ভাবন সম্ভব যা প্রায় ১ কোটি কর্মসংস্থান তৈরি করবে। 

পৃথিবীর মোট অর্থনীতি ৮৮ ট্রিলিয়ন ইউএসডি, যার ৪৪ ট্রিলিয়ন ইউএসডি আসে সমুদ্র থেকে। ২০৫০ সালের দিকে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে ৯০০ কোটি, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে খাওয়াতে হলে সমুদ্রের বিকল্প নেই। পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রধান হাতিয়ার হল সমুদ্র। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ৩২ ভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষিত হয় সমুদ্রে। বায়ুমণ্ডলের অর্ধেকেরও বেশি অক্সিজেনের যোগান দেয় সমুদ্র। একুয়াকালচার, মেরিকালচার, নবায়নযোগ্য শক্তি, কার্বন শোষণ, উপকূল রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে সমুদ্র। 

ছবিঃ শৈবাল চাষ, স্থান: রেজুখাল, কক্সবাজার

পৃথিবীর শীর্ষ ১০ অর্থনীতির মধ্যে সমুদ্রের অবস্থান সপ্তম। সমুদ্র পৃথিবীর ১৫ ভাগ প্রোটিন ৩০ ভাগ তেল ও গ্যাস এবং ৫০ ভাগ ম্যাগনেসিয়ামের যোগান দেয়। এছাড়া জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধের যোগানদাতা এই সমুদ্র। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির অনেকটাই সমুদ্র নির্ভর। অস্ট্রেলিয়া ৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করে সমুদ্র থেকে। বাংলাদেশের ৮১ ভাগ সম্পদই সমুদ্রে রয়েছে আর বাকি ২১ ভাগ স্থলভাগে বিদ্যমান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০১২ সালে মায়ানমারের সাথে ও ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্র বিজয় করে যা সমুদ্র গবেষণায় নতুন দিগন্তের সূচনা করে। 

এস কে আবিদ হোসেন (বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ এসোসিয়েশন) বলেন, বাংলাদেশে সর্বমোট ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা জয় করে। বর্তমানে ৫০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় বঙ্গোপসাগরে। সমুদ্রে ৮ মিলিয়ন টন মাছ আছে যার মধ্যে শুধুমাত্র ০.৭৫ মিলিয়ন টন মাছ ধরা হয় প্রতিবছর। বিশাল একটা অংশ ধরা যায়না। মায়ানমার তার বঙ্গোপসাগরের অংশে বিশাল গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। ভূ-গঠন একই হওয়ায় বাংলাদেশেরও সম্ভাবনা আছে গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার। বঙ্গোপসাগরে পলি পাওয়া যায় যা ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের প্রধান উৎস। এছাড়া কাদামাটি পাওয়া যায় যা সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ২০৩০ সালের দিকে সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে ৫ শতাংশ জিডিপি অর্জন করা সম্ভব। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে যদি সমুদ্র সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। 

প্রকল্প পরিচালক (শৈবাল চাষ) মোঃ শিমুল ভূঁইয়া বলেন, “সী-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল সমুদ্রের অগভীর অংশে জন্মে। এরা পাথর, বালি, খোলস, পরিতক্ত জাল ও অন্যান্য গাছে জন্মায়। ১৬৭০ সালে সর্বপ্রথম জাপানে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ শুরু হয়। বাণিজ্যিকভাবে শৈবাল চাষ শুরু হয় ১৯৪০ সালে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক শৈবালের চাহিদা হল ২৬ মিলিয়ন টন। ২৬ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক শৈবালের বর্তমান বাজার মূল্য ৬.৫ বিলিয়ন ইউ এস ডলার। বর্তমান চাহিদার ৮০ ভাগ সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন করে এশিয়ার দেশসমূহ (চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড)। শুধুমাত্র চীন একাই ৪০ ভাগ সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন করে। সামুদ্রিক শৈবালের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে।“ 

সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর (মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট) বলেন, “আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সকাল বেলা দাঁত ব্রাশের পেস্ট থেকে শুরু করে ঔষধ, খাদ্য ও কসমেটিক্স শিল্পে সী-উইড ব্যবহৃত হয়। অ্যাগার ও ক্যারাজিনান এর মত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সামুদ্রিক শৈবাল থেকে পাওয়া যায়। ভালো মানের ১ কেজি অ্যাগারের দাম ৫০০০ ইউএস ডলার। সাধারণ মানের ১ কেজি অ্যাগারের দাম ১৮ ইউএস ডলার। অ্যাগার প্রধানত গ্রেসিলারিয়া ও জেলেডিয়াম থেকে পাওয়া যায়। আর্জেন্টিনা, কানাডা, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং জাপান প্রধান অ্যাগার উৎপাদনকারী দেশ। ক্যারাজিনান সর্বপ্রথম আয়ারল্যান্ডে উৎপাদিত হয়। কনদ্রাস ক্রিসপাস, ইউকিহেমা, কাপ্পা ফাইকাস থেকে ক্যারাজিনান পাওয়া যায়। আমেরিকা, ডেনমার্ক ও ফিলিপাইন বিশ্বে প্রধান ক্যারাজিনান প্রসেসিং দেশ। খাদ্য হিসেবে সী-উইড চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেশ জনপ্রিয়। জাপানে ফরফাইরা নোরি হিসেবে, লেমিনারিয়া ও সেক্কাহরিনা কম্বু হিসেবে, উনডারিয়া পিন্নাটিফিডা ও পালমারিয়া পালমাটা ওকামি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।“ 

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের ১৯ টি উপকূলীয় জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষ জীবিকার জন্য সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল। এদেশের উপকূল ও মোহনায় প্রায় ১৭৭ ধরনের প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ ছাড়াও টেকনাফ, বাকখালি, ইনানী, কুয়াকাটা ও সুন্দরবনে সী-উইড পাওয়া যায়। সারগাসাম, হিপনিয়া, হেলিমেনিয়া, কিউলারপা, হাইড্রোক্ল্যাথরাস, অ্যাম্ফিওরা প্রজাতি সাধারণত বেশি পরিমাণ লক্ষ করা যায়। বর্তমানে কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়া ও মহেশখালী চ্যানেলে সী-উইড চাষ করা হয়। ১৫ দিন অন্তর অন্তর সী-উইড সংগ্রহ করা হয়। একজন কৃষক মাত্র ১২০০ টাকা ব্যয় করে প্রতি মৌসুমে ১২০০০ থেকে ১৪০০০ টাকা আয় করতে পারে। প্রতিমণ শুকনো সী-উইড এর দাম ছয় হাজার থেকে সাত হাজার টাকা । রাখাইন সম্প্রদায় সী-উইড ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে যুগ যুগ ধরে।”

ছবিঃ শৈবাল চাষ, স্থান: রেজুখাল, কক্সবাজার

বর্তমানে বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের অর্থায়নে বাংলাদেশ মেরিন ফিসারিজ এসোসিয়েশন কক্সবাজারের রেজুখালে শৈবাল চাষের একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট । উক্ত প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোঃ শিমুল ভূঁইয়া বলেন, ব্লু-ইকোনমির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সী-উইড। এদেশের অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও উচ্চ বাজারদরের কারণে সী-উইড নিয়ে ব্যাপক গবেষণা এখন সময়ের দাবি। সী-উইড গবেষণাই পারে ব্লু-ইকোনমির স্বপ্নকে একধাপ এগিয়ে নিতে এবং দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে।

Comments

comments

Posted ৭:১৩ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

dbncox.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

প্রকাশক
তাহা ইয়াহিয়া
সম্পাদক
মোঃ আয়ুবুল ইসলাম
প্রধান কার্যালয়
প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত এবং দেশবিদেশ অফসেট প্রিন্টার্স, শহীদ সরণী (শহীদ মিনারের বিপরীতে) কক্সবাজার থেকে মুদ্রিত
ফোন ও ফ্যাক্স
০৩৪১-৬৪১৮৮
বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন
01870-646060
Email
ajkerdeshbidesh@yahoo.com