দেশবিদেশ অনলাইন ডেস্ক | শনিবার, ৩০ জুন ২০১৮
গত বছরের আগস্টে রাখাইনে সামরিক অভিযান জোরদার করার পর থেকে সেখানে বিদেশি সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল মিয়নামার। এমনকি সেখানে জাতিসংঘের প্রতিনিধি ও মানবাধিকার সংস্থাকে স্বাধীনভাবে পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু যখন বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা কমেছে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার সরকারি তত্ত্বাবধানে রাখাইনে সাংবাদিকদের নিয়ে গেছে দেশটি। নিয়ন্ত্রিত এসব পরিদর্শনে নির্বাচিত স্থানীয় রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষদের শিখিয়ে-পড়িয়ে সরকারি ভাষ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করেছে বলেও বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করছেন রাখাইনের স্থানীয় কর্মকর্তারা।
৩০ জুন ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত ট্রানজিট ক্যাম্প পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয় সাংবাদিকদের। সেখানে স্থানীয় কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলেন, জানুয়ারিতে এই ক্যাম্প চালু হওয়ার পর থেকেই আমরা তাদের গ্রহণে প্রস্তুত।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রানজিট ক্যাম্পটি খালি পড়ে আছে। সেখানে থাকা অভিবাসন কর্মকর্তাদের সাংবাদিকদের অভ্যর্থনা জানানো ছাড়া কোনও কাজ নেই। সেখানে কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, আগস্টে সেনা অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া সাত লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ২০০জনকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
যে অল্প সংখ্যক রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসিত করার দাবি করছে মিয়ানমার তাদের অবস্থাও স্পষ্ট নয়। এপ্রিলে মিয়ানমার দাবি করে ৫ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরে তা ভুয়া বলে প্রমাণিত হলে সমালোচিত হয়। জানা যায়, ওই পরিবার বাফার জোন বলে পরিচিত মিয়ানমারের অংশ থেকেই ফিরে এসেছিল।
এরপরও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ওই পরিবারের সীমান্তের কাছে দাঁড়ানো বড় কয়েকটি ছবি দিয়ে একটি বিলবোর্ড টানিয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে, ছবিতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে অবৈধভাবে পালিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, নৌকায় করে বাংলাদেশ পালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে যারা মিয়ানমারের অংশে আটক হয় তাদের ট্রানজিট ক্যাম্পের মাধ্যমে স্বজনদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
শুক্রবার সাংবাদিকদের সামনে ৯জন রোহিঙ্গা হাজির করা হয়। দাবি করা হয়, অবৈধভাবে মিয়ানমারে ফিরে আসার চেষ্টা করায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। মুক্তির পর তাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।
তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের এই দাবি ভুয়া বলে প্রতীয়মান হয়। এই ৯ রোহিঙ্গার কয়েকজন জানান তারা কখনোই বাংলাদেশ যাননি এবং মিয়ানমারের কারাগার থেকে ক্যাম্পে তাদের প্রত্যাবাসন হয়েছে।
চার সন্তানের বাবা ও পেশায় কৃষক ইয়ার সেইন (৩৫) বলেন, গত বছর নভেম্বরে দেশে (মিয়ানমার) আমরা গ্রেফতার হয়েছিলাম। অভিবাসন আইনে আমাদের চার বছর কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। স্কুল থেকেই আমাদের গ্রেফতার করা হয় এবং অভিযোগ আনা হয় আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমরা বাংলাদেশে ছিলাম না।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিলম্বের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কও ধীরে ধীরে অবনতি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বাফার জোনে মিয়ানমারের অংশ থেকে ছোড়া গুলিতে এক ১০ বছরের রোহিঙ্গা ছেলে নিহত হয়। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে একটি নোট পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এগুলো বৈধ প্রত্যাবাসন নয়। বাংলাদেশের শরণার্থী কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি।
এর আগেও মিয়ানমার সরকারের উদ্যোগে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দলকে রাখাইনের উন্নয়ন চিত্র সরেজমিনে ঘুরে দেখানো হয়। তখনও সেনাবাহিনীর ভয়ে মুখ খুলতে পারেননি রোহিঙ্গারা। সিতওয়েতে থাকা রোহিঙ্গা ট্রানজিট ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন সাংবাদিকরা। সত্যতা যাচাই করতে না পারলেও ওই সময় একজন রোহিঙ্গা যুবকের দেওয়া বক্তব্য তাদের প্রতিবেদনে উদ্ধৃত করেছে পত্রিকাটি। ফয়সাল নামের ওই যুবক বলেছিলেন, ‘আপনারা চলে যাওয়ার পর তারা আমাদের গ্রেফতার করবে।’
সাংবাদিকদের কাছে ভুয়া তথ্য হাজির করলেও মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি দাবি করেছেন, বিদেশ থেকে পরিচালিত বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় মিয়ানমারে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করছে। জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন স্ক্রানারকে তিনি একথা বলেন। কোন সম্প্রদায় এবং কী রকম বিদ্বেষমূলক আখ্যানের কথা বলা হচ্ছে তা জানার জন্য সরকারি মুখপাত্র জাও তায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তবে তিনি কোনও কথা বলেননি।
এছাড়া আগস্টের পর থেকেই সু চি’র সরকার রাখাইনের সহিংসতায় অমুসলিম বাস্তুচ্যুতদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ফেসবুক ও টুইটারে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ফেক নিউজ প্রচারের অভিযোগ করে আসছে মিয়ানমার।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিলম্বের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করে আসছে মিয়ানমার। এই বিলম্বের মধ্যেই মিয়ানমার রাখাইনের পুরো অবকাঠামো পাল্টে দিয়েছে উন্নয়নের নামে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে, রাখাইনে জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যার আলামত বিনষ্ট করতেই বুলডোজার দিয়ে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা যাতে নিজ ভূমি ও ভিটায় ফিরতে না পারে সেটাও নিশ্চিত করছে মিয়ানমার।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, রাখাইনের পরিস্থিতি এখনও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য নিরাপদ ও সহায়ক নয়। তবু পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয় না। এছাড়া সেখানকার রোহিঙ্গারা অবাধ যাতায়াত, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ এ ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ বলে উল্লেখ করেছে।
দেশবিদেশ/30 জুন ২০১৮/নেছার
Posted ৭:১৭ অপরাহ্ণ | শনিবার, ৩০ জুন ২০১৮
dbncox.com | ajker deshbidesh