| বুধবার, ১৭ আগস্ট ২০২২
মোজাফফর আহমদ
মোজাফফর আহমদ
শতবর্ষ আগে পরাধীনতার নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত বাঙ্গালি জাতির ভাগ্যাকাশে মুক্তির প্রভাকররূপে জন্ম নেয়া “খোকা” নামের সেই শিশুটি শিক্ষা—দীক্ষা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, মহত্তম জীবনবোধ সততা, সাহস, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন—সার্বভৗম জাতিরাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙ্গালি। বাঙালির কাছে তিনি পরিনত হলেন অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয় একটি ইতিহাস, একটি দেশ, একটি সংস্কৃতির পুরোধা। তাই, আজ রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যে ইতিহাস রচনা করেছে হাজার বছরের শৃঙ্খল মোচনের এক অমর মহাকাব্য। তিনি প্রজ্জ্বলিত এক নক্ষত্র, অগনিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক প্রস্ফুটিত গোলাপ। বাঙালিরা বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন তাঁর আত্ম—পরিচয়ের ঠিকানা, অহংকারের সাতকাহন, আত্মমর্যাদার প্রতীক—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখেছিলেন শেখ মুজিব। শুধু স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হননি।সে অনুযায়ী রাজনৈতিক পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের সবাই যখন ভারত—পাকিস্তান বিভক্তি নিয়ে ব্যস্ত, সে সময় মুসলিম লীগের তৎকালীন প্রগতিশীল ধারার তরুণ নেতা ২৭ বছর বয়সী শেখ মুজিব দুই বাংলার বাঙ্গালীদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন। তিনি গঠন করেন বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি। ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবনায় তিনি তুলে ধরেছিলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনগনের ভোটে একটি গণ পরিষদ হবে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজকে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব বাংলার ছাত্রলীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। সে সময় কারাগারে বন্দি ২৯ বছর বয়সী শেখ মুজিবকে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় ও বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ভাষা আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন নতুনভাবে শুরু করেন। দলের সাধারণ সম্পাদকের অনুপস্থিতিতে ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসিলম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে এক অসম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ গঠিত হয় এবং তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৬ সালের কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে তাতে তিনি শিল্প বানিজ্য এবং দুনীর্তি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবতীর্তে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে শেখ মুজিব উদ্যোগী হয়ে সমমনা ছাত্র নেতাদের নিয়ে গঠন করেন স্বাধীন বাংলা ‘বিপ্লবী পরিষদ’ নামের গোপন সংগঠন।
তিনি ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের সম্মেলনে সাবজেক্ট কমিটির সভায় ছয় দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিল বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ। এ সময় ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়তে পূর্ব বাংলা সফরে মাত্র দুই মাসের মাঝেই আটবার গ্রেফতার হতে হয় এ মহান নেতাকে।
১৯৬৮ সালের পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে ১ নম্বর আসামি করে ৩৫ জন সামরিক ও সিএসপি অফিসারকে দেশভাগের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত অযুহাতে দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ততদিনে ছয় দফার প্রতি ব্যাপক জনমত তৈরি হয়েছিল এবং ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে ছাত্র অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ ছয় দফাকে অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভ্যূত্থান শুরু করেন।
আন্দোলনের চাপে ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার শেখ মুজিবসহ সকল আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং ২৩ শে ফেব্রুয়ারি এ মহান নেতাকে পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান করেন।
শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে ও গণঅভ্যূত্থানকে রুখতে না পেরে শেষবধি ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। অবশেষে ইয়াহিয়া খান প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জন প্রতিনিধি নির্বাচন এবং অচিরেই দেশে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা চালুর দাবী মেনে নেন।
১৯৭০ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৭ টি আসন পেয়ে একক প্রতিনিধি ও পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
একাত্তরের ৭ মার্চ সারাদেশে টান টান উত্তেজনা। সাধারণ মানুষ তাদের নেতার স্বাধীনতা ঘোষনার অপেক্ষায়। এ মাহেন্দ্রক্ষণে, বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে কৌশলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। সাত মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়েই ঐতিহাসিক ছয় দফা মূলত স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হয়। ৭ মার্চের পর থেকে পূর্ব বাংলা মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তার বাস ভবনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা উঁড়িয়ে দেন। তিনি এই দিনে ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর কুচকাওয়াজে লাল সবুজের পতাকা হাতে গার্ড অব অনার প্রদানকারী দলের সালাম গ্রহণ করেন।
পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নাম দিয়ে ঐ কালো রাতে সারাদেশে একযোগে নিরস্ত্র ও নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং রাত ০১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডি ৩২নং বাস ভবন থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের আগমুহূর্তেতিনি জাতির উদ্দেশ্যে তার শেষ বার্তা প্রদান করেন। এ বার্তায় তিনি বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।
বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
শেষ আমরাই জয়ী হব।
দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীও দেশীয় আল শামস ও আল বদর বাহিনীর বিরোদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ও ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রের স্বাধীন দেশে হিসেবে স্থান পায়। তারপরে বাঙালিরা ফিরিয়ে আনেন তাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে।
১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধুইসলামাবাদ ত্যাগ করেন। তিনি ইংল্যান্ড ও ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন। মানুষ ফিরে পান তাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
দেশে ফিরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার পাশাপাশি দেশের মানুষকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। দেশ গড়ার এ সংগ্রামে চলার পথে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তার দেশের মানুষ কখনও তার ত্যাগ ও অবদানকে ভুলে যাবে না। অকৃতজ্ঞ হবে না। তাই তিনি একটি সুন্দর সোনার বাংলা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হতে চেয়েছিলেন ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরীব, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট্রান নির্বিশেষে সকলের অসাম্প্রদায়িক এবং সাম্যবাদী নেতা ও শোষন অধিকার বঞ্চিত মানুষের আপনজন।
এ প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী বাঙ্গালি অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের কথাটিই যথার্থ— ‘তিনি ছিলেন মানবজাতির পথ প্রদর্শক ও মহান নেতা। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সভ্যতা, সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি’।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে একদল বিপদগামী সেনাসদস্যের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব সহ পরিবারের ১৭ জন সদস্য। স্তব্দ হয়ে যান পুরো বাঙালি জাতি। অবিকশিত রয়ে গেল বাঙালি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। পঁচাত্তরের এ দিনে আগস্ট আর শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেড়া অশ্রুর প্লাবনে।
বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন চিরকাল বাঙালি জাতিকে অনুপ্রানিত করবে, পথ দেখাবে। বাঙালি জাতির শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণে কালজয়ী এ মহান পুরুষকে চিরকাল স্বরণ করবে।
কবির ভাষায় বলতে পারি,
“হে বীর, হে মহানায়ক
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি,
তুমি মরতে পারো না” তুমি যে বঙ্গবন্ধু”
তুমি ছিলে, তুমি থাকবে
আরো হাজার বছর বাঙালির
হৃদয়ের মনি কোঠায়”।
লেখক: মোজাফফর আহমদ, সহকারী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান)
ককসবাজার সরকারি কলেজ।
Posted ২:০৩ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৭ আগস্ট ২০২২
dbncox.com | ajker deshbidesh