দেশবিদেশ অনলাইন ডেস্ক | সোমবার, ২২ অক্টোবর ২০১৮
দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের আগে প্রথম সন্তানকে মানসিকভাবে করতে হবে প্রস্তুত। অনাগত সন্তানের জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে তার আদর-যত্নে যেন কমতি না পড়ে, সেদিকে নজর দিতে বললেন মনোবিদরা। লিখেছেন আতিফ আতাউর কয়েক দিন আগেও মা-বাবার জগতের পুরোটাই ছিল রাইসা। অফিস থেকে ফিরে সারাটা সময় তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন বাবা। মা তো সকাল থেকে রাত অবধি চোখের আড়ালই করতে চান না তাকে। কিন্তু হঠাৎই মা-বাবা দুজনই রাইসাকে এক ভাইয়ের গল্প শোনান। কিছুদিন পরই নাকি তার একটি ভাইয়া হবে। তার জন্য কত প্রস্তুতি। মা-ও যেন তাকে আর আগের মতো ভালোবাসেন না, কাছে টানেন না। এমনটি মনে হতে শুরু করে ৮ বছর বয়সী রাইসার। অনাগত সন্তানকে নিয়ে মা-বাবার উচ্ছ্বাসের সময় আনন্দ পেলেও পরক্ষণেই মন খারাপ হয়। তার সুখের রাজ্যে কি কেউ ভাগ বসাতে আসছে?
কেন এই অভিমান?
রাইসার মতো শিশুদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া অস্বাভাবিক নয় বলে জানালেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার। তাঁর মতে, চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায় ছোট ভাই-বোনদের মধ্যকার এই সম্পর্কটির নাম ‘সিবলিং রাইভালরি’ বা ভাই-বোনের রেষারেষি। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের আগে ও পরে প্রথম সন্তানের মধ্যে আবেগ ও আচরণের কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। অনেক সময় তারা মনে করতে পারে এতে করে তার আনন্দ কিংবা আদর-যত্নে ভাগ বসাতে আসছে অন্য কেউ। এটা ভেবে অভিমান করে। মা-বাবার মনোযোগ কে বেশি পাবে এ নিয়েও দ্বিধা তৈরি হয় তাদের মধ্যে। এতে করে তাদের মানসিকজগতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মনের মধ্যে তৈরি হয় অভিমান।
কী বোঝাই তারে
এমন পরিস্থিতিতে অনেক মা-বাবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। এমনটা হওয়া চলবে না বলে মত দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হক। তিনি বলেন, ‘সন্তান খুব কম বয়স থেকেই তাদের প্রতি মা-বাবার আচরণ ও মনোভাব বুঝতে পারে। মানসিক বিকাশের সময় শিশুদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবোধ তৈরি হয়। নিজের গুণের বিকাশ ঘটিয়ে মা-বাবার মনোযোগ চায়। এই সময়ে যদি বুঝতে পারে অন্য কারো আগমনের কারণে সে আগের মতো মনোযোগ পাচ্ছে না, তখনই তাকে অপছন্দ করতে শুরু করে। এমনটি হতে দেওয়া ঠিক নয়। তাকে বোঝাতে হবে যে আসছে সে তোমার খুব কাছের আপনজন।’
তিনি আরো বলেন, ‘মা গর্ভবতী হওয়ার পর প্রথম সন্তানটি হয়তো আগের মতো মায়ের কোলে উঠতে পারে না, যখন-তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না। কিংবা মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলেও বাধা পেয়ে ফিরে আসে। এ নিয়ে মন খারাপ করে। তাকে বোঝাতে হবে মায়ের পেটে তার ভাই কিংবা বোন আসছে। সে জন্ম নিলে একজন খেলার সঙ্গী পাবে। তাকে ভালোবাসতে পারবে। শিশুদের বুঝিয়ে বললে তারা বোঝে। প্রথম সন্তানকে দূরে ঠেলে না দিয়ে অনাগত সন্তানের দেখভাল এবং ভালো-মন্দের বিষয়গুলো সঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে তাদের।’
মেখলা সরকার বলেন, ‘প্রথম সন্তানের প্রতি আদর-যত্ন কমে যাচ্ছে এটা যতটা সম্ভব বুঝতে দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয় সন্তানের যত্ন নিতে গিয়ে তাকে দেওয়া সময় কমে গেলে তা-ও বুঝিয়ে বলতে হবে। তাকে দেওয়া সময় যে তারই ভাই কিংবা বোন পাচ্ছে এটা জানাতে হবে। এতে করে সে দায়িত্ববোধ শিখতে শুরু করবে। তার মধ্যে ভালোলাগা তৈরি হবে। মা-বাবা সন্তানের প্রশংসা করলে তারা খুব খুশি হয়, মোটিভেটেট হয়।’
শেয়ারিং অ্যান্ড কেয়ারিং
অনাগত সন্তান আসার বিষয়টি শিশুর সঙ্গে শেয়ার করার পরামর্শ দিলেন মেহজাবিন হক। বলেন, ‘পরিবারে যে সন্তানটি আছে তার কাছে দ্বিতীয় সন্তান আগমনের বিষয়টি লুকানো যাবে না। প্রথম থেকেই সন্তান আসার বিষয়টি তার সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, অনাগত সন্তানের সুস্থভাবে আগমনের জন্য মাকে দেখভালের কিছু দায়িত্বও তাকে দেওয়া যেতে পারে। যেমন—মাকে এই সময়ে যখন-তখন বিরক্ত করা যাবে না। তাঁর ঘুমানোর সময় চিত্কার-চেঁচামেচি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মাকে সময়মতো ওষুধ খাওয়ার কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিন তাকে। অনাগত সন্তানের যত্ন-আত্তির জন্য কেনা জিনিসপত্রগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব দিলেও সে খুশি হবে।’
সন্তান জন্মের পর তার প্রতি সময় কমে যাবে, তাকে আর আগের মতো সময় দেওয়া যাবে না এটাও বুঝিয়ে বলতে হবে। সে যে একজন বড় ভাই কিংবা বড় বোন হতে যাচ্ছে এই অনুভূতিটুকু তার মধ্যে তৈরি করে দিতে হবে। ছোট সন্তান জন্ম নেওয়ার পর তাকে সবাই একটু বেশি ভালোবাসতে শুরু করে। খেলনা কিনে দেয়। বড়টার প্রতি আদর-যত্ন কমে যায়। এই সময় খেলনার ভাগ বড়টাকে দিন। মা ছোট সন্তানকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকলে বাবাকে বড়টার দিকে এগিয়ে আসতে হবে।
অপেক্ষা তারও
পরিবারে নতুন অতিথি আসছে। মা-বাবাসহ সবাই যখন তাকে নিয়ে অপেক্ষায় অস্থির, তখন অপেক্ষা হোক তারও। দ্বিতীয় সন্তানকে সে যেন কোনোভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভেবে না বসে। তাকে একজন খেলার সঙ্গী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারলে এই অপেক্ষা তার কাছেও মধুর মনে হবে। বাসায় খুনসুটি করার একজন সঙ্গী পেলে শিশুরা খুশি হয়।
সঙ্গী হোক সে-ও
মাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রথম সন্তানটিকেও সঙ্গী করুন। তাকে দূরে সরিয়ে না রেখে দ্বিতীয় সন্তান আগমনের অংশ করে নিন। ডাক্তারের রিপোর্টগুলো তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখান, বুঝিয়ে দিন। এতে সে নিরাপদ বোধ করবে। অনাগত সন্তানের জন্য আগে থেকেই কিছু জিনিসপত্র কিনে রাখতে হয়। এটা কেনার সময় প্রথম সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে যান। তাকে তার অনাগত ভাই কিংবা বোনটির জন্য পছন্দ করতে দিন। এতে খুব খুশি হবে সে।
মনে রাখতে হবে
মা-বাবাকে এই সময়টাতে দুই সন্তানের দিকেই খেয়াল রাখতে হবে বলে জানান মেহজাবিন হক। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর প্রথম সন্তানকে নানির বাড়ি পাঠিয়ে দেন মা-বাবারা। এটা কোনোভাবেই করা যাবে না। এটা করলে যে ভাই কিংবা বোনটি হলো তার প্রতি হিংসাত্মক হয়ে উঠবে প্রথমজন। দুই সন্তানকে একসঙ্গে দেখভাল করা একটু কঠিন। তবে সেটা মা-বাবাকে মিলে ম্যানেজ করে নিতে হবে। বরং বড় সন্তানকে ছোটটির জন্য এটা-ওটা এগিয়ে দেওয়ার জন্য বলা যেতে পারে। এতে করে তার মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে উঠবে। স্নেহ ও মমত্ববোধ তৈরি হবে।’
জোর করে নয়, খেলনা ভাগাভাগি থেকে শুরু করে যেকোনো কিছুর শেয়ারিংয়ের বিষয়টা তাকে এমনভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে, যেন সে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করতে সম্মত হয়
Posted ৯:৩০ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২২ অক্টোবর ২০১৮
dbncox.com | ajker deshbidesh