এম.আবদুল্লাহ আনসারী, পেকুয়া | সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫ | প্রিন্ট | 103 বার পঠিত | পড়ুন মিনিটে
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার টইটং, শিলখালী ও বারবাকিয়া পাহাড়ী জনপদের প্রবাহিত ছড়াগুলো স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা নির্বাহে পানির উৎস হিসেবে ছিল একমাত্র ভরসা। এখনকার সময়ে সুপেয় পানির অভাব পূরণে বিচ্ছিন্ন ভাবে টিউবওয়েল স্থাপন করা হলেও চাষাবাদ ও গোসলের মাধ্যম এখনো প্রবাহিত ছড়া। কিন্তু এখন সেই প্রবাহিত ছড়াই হয়ে উঠেছে দখলবাজদের বালি আহরনের পথেয়। বনাঞ্চল ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের সকল নিয়ম নীতিকে তোয়াক্কা না করে সংরক্ষিত বনভূমির এক কিলোমিটারের ভেতরে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। সরকারি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা নিয়ে বালু মহাল চালু হয়েছে। কিন্তু ইজারা এলাকার সীমানা অমান্য করে বনবিভাগের অভ্যন্তরে বসানো হচ্ছে শ্যালো মেশিন ও মোটরপাম্প। রাতের অন্ধকারে চলে বালু তোলার কাজ, আর দিনের আলোয় পাহাড়ের অংশবিশেষ ধসে পড়ে নামছে ছড়ায়।
সরজমিনে দেখা গেছে, টইটং ইউনিয়নের বটতলী ও সোনাইছড়ি ঢালারমুখ জুমপাড়া এলাকায় অসংখ্য মেশিন বসানো। আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল আলম সওদাগর, যুবলীগ নেতা নবু মেম্বার, জমিরসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা বালু উত্তোলনে যুক্ত। স্থানীয়দের অভিযোগ, তারা কখনো আওয়ামী লীগ পরিচয়ে, কখনো বিএনপি-জামায়াত পরিচয়ে প্রশাসনের অনুকম্পা নেন।
এছাড়া হাবিবপাড়া ও মালঘারা এলাকায় অন্তত ১৪টি মেশিন দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ হোছনের ছেলে রেজাউল করিম, মৃত দানু মিয়ার ছেলে আবদুল মজিদ, হাজী আবদুর রহমানের ছেলে আজিজুল হক ও হামিদুল হকসহ অনেকে প্রকাশ্যে বালি তোলার কাজে যুক্ত।
স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা বাঁধা দিলে তারা বলে ইউএনও থেকে লাইসেন্স নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১লা বৈশাখ থেকে এক বছরের জন্য ৩৫ লাখ ৭০ হাজার টাকায় টইটংয়ের সোনাইছড়ি বালু মহালের ইজারা নিয়েছেন পেকুয়ার আনোয়ারুল কাদের লিটন। তাঁর দাবি, উপজেলা প্রশাসনের উপস্থিতিতেই ৭ একর জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু বনবিভাগ বলছে, তাদের আপত্তি সত্ত্বেও জেলা প্রশাসন ইজারা দিয়েছে সংরক্ষিত জায়গার কাছাকাছি। এখন ইজারার আড়ালে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বনভূমির ভেতরে প্রবেশ করে বালু তুলছেন।
বনবিভাগের বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা খালেকুজ্জামান বলেন, ‘ইজারার সীমার বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলন স্পষ্টতই অবৈধ। স্থানীয় বিট কর্মকর্তাকে দায়ীদের শনাক্ত করতে বলা হয়েছে। শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। জনবল সংকটের কারণে তাদের ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, অসংযত বালু উত্তোলনে ছড়ার বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। বহু মানুষের বসতঘর ভেঙে তলিয়ে গেছে। চলাচলের রাস্তা ভারি ট্রাকের চাপ সামলাতে না পেরে ধসে পড়ছে। ফলে সাধারণ মানুষকে এখন হাঁটাপথেই চলাচল করতে হচ্ছে।
স্থানীয়দের ক্ষোভ, বালু ব্যবসায়ীরা শুধু পাহাড়ি ছড়াই নয়, তাদের জীবনও গিলে খাচ্ছে। প্রশাসন সব জেনেও চুপ।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মঈনুল হোসেন চৌধুরী ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে উত্তোলিত বালু সরানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু দুই মাস পেরোলেও সেই নির্দেশ মানা হয়নি। বরং রাতের পর রাত অব্যাহত থেকেছে বালু তোলা।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) নুর পেয়ারা বেগম অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি কখনো অবৈধভাবে তোলা বালু পরিমাপ করতে যাননি। তাঁর ভাষায়, তহসিলদার গিয়েছেন হয়তো, কিন্তু আমি কিছুই জানি না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেকুয়ার সংরক্ষিত বনের ভেতর পাহাড়ি ছড়াগুলোতে এভাবে বালু তোলা চলতে থাকলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। পাহাড় ধসে পড়া ও নদী-ছড়া ভাঙন নতুন করে দুর্যোগ ডেকে আনবে।
পরিবেশ কর্মীরা মনে করেন, বালু উত্তোলনের সঙ্গে প্রশাসনের একাংশ ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের আঁতাত না থাকলে এত বড় পরিসরে এ অনিয়ম চলতে পারত না।
কাগজে-কলমে বৈধ ইজারা থাকলেও বাস্তবে তা পরিণত হয়েছে প্রভাবশালীদের অবৈধ ব্যবসায়। পাহাড় কেটে ছরায় ফেলা হচ্ছে বালি, ভাঙছে বেড়িবাঁধ, হারাচ্ছে ঘরবাড়ি। স্থানীয়দের অভিযোগ, বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও এ কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
প্রশ্ন উঠছে- প্রকৃতি ধ্বংসের এই খেলার শেষ কোথায় ? কক্সবাজারের পেকুয়ায় কি প্রশাসন সত্যিই সক্ষম হবে অবৈধ বালি উত্তোলন ঠেকাতে, নাকি বনভূমি ও পাহাড়ের অস্তিত্ব শুধু কাগজে-কলমেই টিকে থাকবে ?
ডিবিএন/জেইউ।
.
এ বিভাগের আরও খবর