দেশবিদেশ অনলাইন ডেস্ক | বৃহস্পতিবার, ০৫ জুলাই ২০১৮
জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার আশ্বাসের পরও প্রত্যাবাসন নিয়ে হতাশায় রয়েছেন রোহিঙ্গারা। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদল, গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা এবং বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী-এমপিরা একাধিকবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। সর্বশেষ পরিদর্শনে আসেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এবং বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। তারা রোহিঙ্গাদের সহায়তার নানা ধরনের আশ্বাসও দিয়ে গেছেন। তবে রোহিঙ্গাদের দাবি, নেতারা আসে-যায়, কিন্তু মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে কোনও সমাধান হয় না।
২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ২৪ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার সরকারের হাতে বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের দেখতে এই পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন বিশ্বের বড় বড় নেতারা। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার একাধিক টিম, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য, কফি আনান কমিশন, ওআইসি, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সদস্যসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থার একাধিক প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। এতে রোহিঙ্গাদের মাঝে কিছুটা স্বস্থি ফিরলেও এখন তাদের মধ্যে কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছে। কারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে এই কর্মকর্তারা তেমন কিছুই করতে পারছেন না। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক মহল চাপ সৃষ্টির কথা বলে আসলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফলে স্বদেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুর বলেন, ‘আমরা খুবই হতাশ। সেই হতাশার কথা জানিয়েছি জাতিসংঘের মহাসচিবকে। আমরা বলেছি অতীতে বিশ্বের অনেকেই আমাদের দেখতে এসেছেন। আমাদের কথা শুনেছেন। এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু পরিদর্শনে এসে প্রতিনিধিদল আমাদের যে আশ্বাস দেন তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।’তিনি আরও বলেন, ‘আমরা হতাশার কথা জানিয়েছি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমকেও। তিনিও সবার মতো আমাদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা আশ্বস্ত করেছেন যেকোনও উপায়ে নিরাপদে আমাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করবেন।’
জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা জোহুরা বেগম (৪৫)। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আমাদের ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে আমি সব কিছু মহাসচিবকে খুলে বলেছি। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন এই বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে আরও বলেছেন, জাতিসংঘ সব সময় রোহিঙ্গাদের পক্ষে আছে এবং থাকবে। এজন্য আমাদের একটু ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন। কিন্তু এরপরও আমি হতাশ। এই পর্যন্ত অনেক নেতা আমাদের আশ্বস্ত করে গেছেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’
উখিয়ার কুতুপালং ডি-৫ ব্লকের বাসিন্দা রোহিঙ্গা যুবক আবু সৈয়দ (৩৫) বলেন, ‘আমরা শুধু আশায় বুক বেঁধে বসে আছি। কিন্তু কবে নাগাদ আমাদের প্রত্যাবাসন হবে জানি না। এই পর্যন্ত অনেক নেতা আমাদের দেখতে এসেছেন। কিন্তু কেউ আমাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের নিশ্চিয়তা দেননি। শুধু আশার বুলি ঝুলিয়ে চলে গেছে। জানি না আমরা কবে আমাদের দেশে ফিরতে পারবো। আমাদের দেশে ফেরা হয় না।’
কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের মৌলভী জাফর আলম বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ইউএনএইচসিআর এবং মিয়ানমারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে— এ নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে আমরা বলেছি, ওই চুক্তির মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ পুরো অধিকারের কথা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে করে রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে গেলেও পুনরায় নানা নির্যাতনের শিকার হতে হবে। উত্তরে-জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, তোমাদের অধিকার যাতে সম্পূর্ণভাবে ফিরে পাওযা যায় সে ব্যবস্থা করছি। এসব বিষয়গুলো সব ঠিক হয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।’
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লালু মাঝি বলেন, ‘আশা করি আমরা আর মিয়ানমারে ফিরতে পারবো না। কারণ আন্তর্জাতিক মহলকে কোনও তোয়াক্কায়ই করছেন না মিয়ানমার সরকার। একের পর এক মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারসহ পুরো বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ ১০ মাস হয়ে গেলেও আমাদের প্রত্যাবাসনের কোনও সুরহা মিলছে না।’.
সর্বশেষ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। গত ২ জুলাই সোমবার সকালে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের জন্য তারা কক্সবাজারে আসেন। উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্প, মধুরছড়া, কুতুপালং ডি-৫সহ বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এসময় তারা মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেন।
২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতের পর থেকে আসা ৭লাখ রোহিঙ্গাসহ নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে নিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১১ লাখের ওপরে। এসব রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রথমে তিন হাজার একর ও পরে সংকুলান না হওয়ায় আরও দুই হাজার একরসহ মোট পাঁচ হাজার একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে। পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে তাদের খাবার, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। একইভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ নানা অধিকার নিয়ে যাতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে।
দেশবিদেশ / ০৫ জুলাই ২০১৮/নেছার
Posted ২:১৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ জুলাই ২০১৮
dbncox.com | ajker deshbidesh