--- জহির সিদ্দিকী --- | সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
বিশ্বনন্দিত পর্যটন শহর কক্সবাজারস্থ নয়াভিরাম দ্বীপ মহেশখালী। মতান্তরে ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জ্লোচ্ছ্বাসে মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সৃষ্ট এ দ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় চার লক্ষাধিক। এটি বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ী দ্বীপ। সবুজ পাহাড়, নদী এবং সাগরের অপূর্ব মিলন ধারার মিতালীর সন্নিবেশস্থল মহেশখালী। প্রায় ৩৬২.১৮ কি.মি. আয়তনের দ্বীপটির ঐতিহ্যবাহী মিষ্টিপান, লবণ, চিংড়ী, শুটকি, খনিজ বালি দেশে- বিদেশে বাজারজাতকরণের মধ্য দিয়ে দেশের উন্নয়নের অর্থনৈতিক চাকা সচল রেখেছে আবহমান কাল ধরে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস নানা প্রতিকূলতায় বেড়ে উঠা সংগ্রাম মূখর দ্বীপবাসীর দেশপ্রেম, আন্তরিকতা, উদারতা অবিস্মরণীয়। দু:খের বিষয় হলেও সত্য যে, নানা বৈষম্যের গ্যাড়াকলে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূৃমিকা রাখা দ্বীপবাসী বারংবার তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। উৎপাদন শিল্পের মূল্যায়ন, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ, পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণ ইত্যাদির দাবী আদায়ে জনগণ ও সচেতন মহল সদা সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু অপরাজনীতি ও স্বার্থের দাবানলে সহজ-সরল দ্বীপবাসীর সকল প্রাপ্যতা, অধিকার পর্যবসিত হয়েছে বহুবার, বহুভাবে। আজ দাবী আদায়ের সময় এসেছে। মানুষের মধ্যে চেতনার উদয় হয়েছে। দেশের উন্নয়নে মেহনতি মানুষের অবদানের মূল্যায়ন আজ সময়ের দাবী। সরকার দেশের অগ্রগতির লক্ষ্যে মহেশখালীকে ঘিরে নানান মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে। দ্বীপবাসী আজ জন্মভূমির স্বাধিকার রক্ষায় ঐক্যের সুরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান দিতে চায়- উৎপাদন, শ্রম আর বৃথা নয়, মূল্যায়ন চাই।
হয়ত অনেকেই জানার ইচ্ছে পোষণ করবেন – মহেশখালীতে কি আছে ? কেন সরকারের দৃষ্টি ঐদিকে? কোন কোন খাত দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে? কৌতূহলীদের কৌতূহল মেটাতে সংক্ষিপ্ত একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরতে চাই।উৎপাদনের দিক দিয়ে দ্বীপের ৫৫% লবণচাষী, ৬.৯০% ব্যবসায়ী, ২১.১৭% কৃষক, ১৫% পানচাষী, ০.৯৭% চাকরীজীবি। অন্যদিকে পর্যটন শিল্প হিসেবে নান্দনিক রাখাইন বৌদ্ধ মন্দির, ঐতিহাসিক আদিনাথ মন্দির, মনোরম সমুদ্র সৈকত, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, নদী-পাহাড়ের মিতালী ইত্যাদির রয়েছে সুখ্যাতি। যা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। তাছাড়াও দেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে যেসব প্রকল্প হাতে নেয়া দরকার সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের উপযুক্ত স্থান একমাত্র মহেশখালী। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প সমূহ সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো।
ক) গভীর সমুদ্র বন্দর:-
জাপানের অর্থায়নে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মহেশখালীর মাতারবাড়ী-ধলঘাটায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। যা জাপানের কাশিমা এবং নিগাতা পোর্টের মডেলের আলোকে নির্মিত হবে। এটি নির্মিত হলে আধুনিক কনটেইনারবাহী জাহাজ, খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাংকারকে জেটিতে ভিড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর চাপ কমবে, সেই সাথে দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।
খ) কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র :-
মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ীর দক্ষিণ প্রান্তে ১৪১৪ একর এবং উত্তর প্রান্তে ১২০০ একর জমিতে তা গড়ে তোলা হবে। দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার শতকরা ১৮ ভাগ উৎপাদন ও সরবরাহ করা হবে এখান থেকে।
গ) ধলঘাট থেকে ফাঁসিয়াখালী সড়ক:-
বাংলাদেশ বন্দর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জাইকার অর্থায়নে মহেশখালীর ধলঘাট থেকে চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী পর্যন্ত প্রায় ২৫ কি.মি. চারলেন সড়ক বাস্তবায়ন করবে। এতে যাতায়তের সুবিধাসহ অর্থনৈতিক পণ্য বাজারজাত সহজ হবে।
ঘ) এলএনজি টার্মিনাল :-
সমুদ্র পথে সহজে যোগাযোগ এবং ভবিষ্যতে প্রতিবেশী মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক প্রবৃদ্ধি এবং শিল্পায়নের অপার সম্ভাবনা বিবেচনায় উপযুক্ত স্থান হিসেবে মহেশখালীর সোনাদিয়ায় এলএনজি ( লিকুফাইড ন্যাচরাল গ্যাস) টার্মিনাল স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এক লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ( মহেশখালী থেকে আনোয়ারা) জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ সম্ভব হবে।
ঙ) চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপ লাইন কনস্ট্রাকশন ক্যাম্প:-
মহেশখালীর কালারমার ছড়া ইউনিয়নের নয়াপাড়া ও সোনার পাড়ার পশ্চিমে প্রায় ১৩৯ একর জায়গায় চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপ লাইন ( সিপিপি) এর জন্য কনস্ট্রাকশন ক্যাম্প স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়।
চ) অর্থনৈতিক জোন:-
দেশি-বিদেশীদের বিনিয়োগ আকর্ষণ ও জ্বালানী, ইস্পাত শিল্পের সুবিধার্থে সমুদ্র বন্দর এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় ও অন্যান্য এলাকায় মোট ৫ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ( বেজা) এর মতে, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে।
ছ) সড়ক ও রেলপথ সংযোগ:-
গভীর সমুদ্র বন্দরের সাথে সড়ক ও রেলপথ সংযোগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সহজ যাতায়ত সুবিধার জন্য সমুদ্র বন্দর থেকে সরাসরি কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকার মহাসড়ক ও রেলওয়ে লিংক স্থাপিত হবে।
তাছাড়াও সরকার দেশকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বহুমূখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে ডিজিটাল আইল্যান্ডে রূপদান, মহেশখালী-চৌফলদন্ডী ফেরিঘাট, পেট্রোলিয়াম কমপ্লেক্স, কালারমার ছড়া টু ধলঘাট সেতু, হাসপাতাল নির্মাণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দেশ ও দশের ভাগ্যের উন্নয়নে সরকারের মেগা প্রকল্প সমূহ নির্দিষ্ট সময়ে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি।
দেশের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান ও আনুগত্য দেখিয়ে দ্বীপবাসী নিজেদের বসতভিটা, জীবনভিটা বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন এবং দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। তাতে বিন্দু পরিমাণ কুন্ঠাবোধ ছিলনা। তাই আপামর জনগনের আনুগত্য ও বিসর্জনের মর্যদা অক্ষুন্ন রাখতে সরকারের প্রতি সবিনয়ে কিছু প্রস্তাব রাখার প্রয়াস করছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তা হবে মহেশখালীবাসীর প্রাণের দাবি।
১) যে প্রকল্প যে এলাকায় বাস্তবায়ন হবে সে প্রকল্পের নামকরণে ঐ এলাকার নাম ( গ্রাম/ইউনিয়ন) সংযুক্ত করতে হবে।
২) প্রকল্প বাস্তবায়নে তথা কর্মক্ষেত্রে জনবল নিয়োগে নির্ধারিত প্রকল্প এলাকার তথা স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দিতে হবে। যোগ্যতা ও দক্ষতার অভাব হলে প্রতিবেশী গ্রাম বা ওয়ার্ড বা এলাকা থেকে জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৩) জমি অধিগ্রহণের ফলে ভূমিহীনদের কম সময়ের মধ্যে পুনর্বাসন করতে হবে।
৪) প্রকল্পে নিয়োগকৃতদের প্রকল্প বাস্তবায়নের পর চাকরী স্থায়ী করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৫) প্রকল্পের আশে-পাশের পরিবেশে যেন ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬) জমির মালিকদের ন্যায্য পাওনা হস্তগত করার সহজ প্রক্রিয়া অবলম্বন এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে।
৭) জমির মালিকদের পাওনা আদায়ে তৃতীয় পক্ষের হয়রানি থেকে মুক্ত রাখার সর্বাত্মক প্রশাসনিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
৮) জনবল নিয়োগে স্ব স্ব এলাকার চেয়ারম্যানদের অগ্রাধিকার মর্মে প্রাধিকার দিতে হবে।
৯) জমির মালিকদের গ্রীণ কার্ড প্রদানপূর্বক প্রকল্পের নানাবিধ সুবিধা ভোগ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১০) পান, লবণ, চিংড়ী, শুটকী ইত্যাদি শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ ও মূল্যায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১১) ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসিত এলাকায় মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা গ্রহন ও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
১২) নান্দনিক শিল্প ও পর্যটন এলাকা গড়ার সাথে সাথে শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নতি সাধনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
১৩) মহেশখালী দ্বীপের চতুর্দিকে ওয়ান বাই রোড করত সুন্দর বনায়ন পূর্বক শক্ত নিরাপদ বেড়ীবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
১৪) সকল প্রকল্পের প্রধান কার্যালয় স্ব স্ব ইউনিয়ন সদরে স্থাপন করতে হবে।
১৫) মহেশখালীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আধুনিকীকরণে ও সুবিধা প্রদানে ভূমিকা রাখতে হবে।
বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত আয়ের দেশে পরিণত করার যে স্বপ্ন তা স্বার্থক করতে হলে গৃহীত প্রকল্প সমূহ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। বাস্তবায়নের সূচনা স্বরূপ গত ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ খ্রি, তারিখে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মহেশখালীবাসীর প্রতি মূল্যায়নের নিরিখে ঘোষণা দেন- ” প্রকল্প এলাকার তথা স্থানীয়দের চাকরিসহ সকল সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। উচ্ছেদকৃত পরিবারের পুনর্বাসন, ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।” মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর সেই দিনের আশার বাণীর বাস্তবায়নের আশায় বুক বেঁধে আছে দ্বীপবাসী। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও নেতৃবৃন্দের নিকট আকুল আবেদন- মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর আশ্বাসটুকু এবং প্রাণের দাবি সমুহ বিবেচনায় রেখে উন্নয়ন প্রকল্পে সর্বত্র ও সর্বাগ্রে স্থানীয়দের প্রাধান্য নিশ্চিকরণ আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। জয় হোক মাতৃভূমির, জয় হোক দ্বীপবাসীর।
লেখক:- শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক।
Posted ২:৩৫ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
dbncox.com | ajker deshbidesh