শেখ রাসেল, টেকনাফ | মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩
# এক বছরে বিজিবির উদ্ধার ৩৩ লাখ ইয়াবা
# কোস্টগার্ড ২৬ লাখ, ডিএনসি ১১ লাখ
# র্যাব ও পুলিশের উদ্ধার বিপুল ইয়াবা
টেকনাফে ইয়াবার ভয়াল থাবা সর্বাগ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। উপজেলার প্রতিটি পাড়া মহল্লায় পাল্লা দিয়ে চলছে ইয়াবার দুন্ধুমার কারবার। পুরান কারবারিদের অনেকেই স্বরূপে ফিরেছে এ পেশায়, সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন কারবারিরাও। গত এক বছরে বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের পৃথক অভিযানে ধরাও পড়েছে প্রায় এককোটির বেশি ইয়াবা। তবে এসমেয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে আরো কয়েক কোটি ইয়াবা দেশে ঢুকে পড়েছে এমন ধারণা সচেতন মহলের। সীমান্তে ইয়াবার যে আগ্রাসী কারবার শুরু হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে টেকনাফে এখন ইয়াবার ভরা যৌবন চলছে। সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন করে ইয়াবা কারবার এখন সিন্ডিকেট ভিত্তিক চলছে। এই সিন্ডিকেটের কেউ কেউ ঢাকা, চট্রগামে বসেই নিয়ন্ত্রন করছে পুরো কারবার। এলাকায় রয়েছে মিয়ানমার থেকে আনা ইয়াবার বড় ডিলার। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে নিয়মিত ইয়াবা উদ্ধার ও মাদক কারবারিরা আটক হলেও থামাতে পারছেনা ইয়াবার কারবার। এর প্রধান কারণ, সীমান্তে এখন নতুন করে ইয়াবা কারবারে যুক্ত হওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক বেশি। কোন কোন এলাকায় ঘরে ঘরে ইয়াবা কারবার চলছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে ,টেকনাফের মাদক কারবারীদেরকে স্থানীয় অনেক জনপ্রতনিধিরাও পৃষ্ঠপোষকতা করছে । টেকনাফ উপজেলায় এমনও অনেক জনপ্রতিনিধি রয়েছে, যারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণায়ের তালিকাভুুক্ত মাদক ব্যবসায়ী । আবার মাদক মামলায় অনেকের সাজাও হয়েছে । এরপরেও তারা ছাড়ছে না মাদক করবার । তাদের দাপুটের কারণে সাধারাণ মানুষের মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না । মেজর (অব )রাশেদ মোহাম্মদ সিনহা হত্যার পরে আত্মসমর্পণ কারি ইয়াবা ব্যবসায়িরা আস্তে আস্তে জামিনে বের হয়ে আবারো পুরাতন পেশা ইয়াবা ব্যবসায় ফিরতে থাকে । এসব ইয়াবাডনরা আবরো সিন্ডিকেট করে জমজমাটভাবে চালিয়ে যাচ্ছে মরণনেশা ইয়াবা ব্যবসা । এসব সিন্ডিকেটের কোনো একজন লোক ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেই জানা যায় তারা এখনো কিভাবে সক্রিয় হয়ে পুরোদমে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে,প্রশাসন মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে রয়েছে । কোনোভাবেই মাদক কারবারীরা ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই । তবুও টেকনাফে থামছে না মাদকের ঢল !
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ টেকনাফ (২ বিজিবি) সূত্র জানা গেছে, গেল বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ২৫২ টি মামলায় ২৬৭জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয় । এসময় আরও ৩৯ জন আসামি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় । তবে সেই ৩৯জনকে মামলায় পলাতক আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে ২ বিজিবি সূত্রে।
উক্ত ২৫২ টি মামলায় মালিকবিহীন ১৫ লাখ ৪৪ হাজার ২৭০ পিস ও মালিকসহ ১৮ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭১ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছেন । সর্বমোট ৩৩ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪১ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। মালিকসহ ২৭ কেজি ১০৮ গ্রাম ও মালিকবিহীন ৩০ কেজি ১৮৭ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস ) উদ্ধার করেন বিজিবি ।
মোট তিনশত ৮৭ কোটি ৮৩ লাখ ৮২ হাজার তিনশত টাকা মূল্যমানের মাদক উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (টেকনাফ ২ বিজিবি ) এর সদস্যারা । এসময় আরও অন্যান্য অবৈধ মালামালসহ সর্বমোট তিনশত ৯৯ কোটি ৬৪ লক্ষ ৯৯ হাজার পাঁচশত ৯২ টাকার মালামাল উদ্ধার করতে হয়েছেন ।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে কোস্টগার্ড (বিসিজি স্টেশন টেকনাফ ) সদস্যরা মাদক বিরোধী অভিযানে ২৬ লাখ ৮১ হাজার ২০ পিস ইয়াবা ও ৩ কেজি গ্রাম ক্রিস্টালমেথ (আইস ) উদ্ধার করেছেন । যার আনুমানিক মূল্য ৯৮ কোটি ৯৩ লাখ ৬ হাজার টাকা । এসময় ১৩ টি স্বর্ণেরবার মদ,বিয়ার,গাঁজাসহ অন্যান্য অবৈধ মালামাল উদ্ধার করতে সক্ষম হয় । মোট ২০২২ সালে ১০০,৬৪,৫৬,৬৭৫ টাকার মাদকসহ অন্যান্য মালামাল উদ্ধার করেন ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর টেকনাফ বিশেষ জোনের সূত্রে জানা গেছে , ২০২২ সালের পুরো এক বছরে ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৪৭ পিস ইয়াবা ও ২ কেজি ৭৬৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস ) উদ্ধার করেছেন । এসময় নগদ টাকা উদ্ধার করেন ২ লাখ ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয় । তাছাড়া পুরো বছেরে চোলাইমদ ,গাঁজা,ফেনসিডেল,বিয়ারসহ বিভিন্ন প্রকারের মাদক উদ্ধার করেন । যার আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি ৮৭ লাখ ৭৩ হাজার ১০০ টাকা । ১৭৩টি মামলায় ২৫১জন আসামি আটকপূর্বক উল্লেখিত মাদদ্রব্যগুলো উদ্ধার করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর টেকনাফ বিশেষ জোনের সদস্যরা । এসময় ১৯২ জনকে গ্রেপ্তর করা সম্ভব হলেও ৫৯ জন পলাকত রয়েছে বলে জানা গেছে । অনুসন্ধানের আরও জানা গেছে , টেকনাফে প্রতিটি ইউনিয়নে কয়েকটি মাদকের সিন্ডিকেট বেপরোয়া রয়েছে । এসব সিন্ডিকেটের হাতে রয়েছে ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্র । এই অস্ত্রধারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রায় সময় ধরাছোঁয়ার বাহিরে থাকার কারণে মাদক করবারীদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না । টেকনাফে কয়েকটি মাদক কারবারী সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে কাজ করছে সদর ইউনিয়নের হাজম পাড়া এলাকার মৃত সালেহ আহমদের পুত্র জকির ,মৌলভী পাড়ার একরাম ও তার ভাই আব্দুর রহমান, একই এলাকার রাসেল প্রকাশ বার্মাইয়া রাসেল, রিদুয়ান,আব্দুর রাজ্জাক, হোছন প্রকাশ চোরা হোছন,খালেক , সাইফুল ওরফে দাউদ ইবরাহীম, শাহপরীর দ্বীপ মাঝের পাড়ার হেলাল উদ্দিন, নুরুল আলম, করিম উল্লাহ, কোনার পাড়ার মো. জুবায়ের, উত্তর পাড়ার শামশুদ্দিন, আছম,দক্ষিণ পাড়ার জাফর আলম । হ্নীলা ইউপির রঙ্গীখালী এলাকার জামাল মেম্বারের ছেলে শাহ আজম,গুরা মিয়ার ছেলে গিয়াস বাহিনীর প্রধান গিয়াস উদ্দীন, মৃত রুহুল আমিনের ছেলে আনোয়ার হোসেন, মৃত ইসমাইলে ছেলে ইদ্রিস , দরগাহ পাড়া এলাকার আহমদ প্রকাশ বস্ত্র বিতানের আহমদ,লেদা এলাকার মীর কাশেমের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, একই এলাকার হাফেজ শফিক,পূর্ব সিকদার পাড়ার শামশুল ছেলে সাইফুল ইসলাম প্রকাশ আতর বিয়ারির ছেলে সাইফুল, ফয়সাল প্রকাশ সুরঙ্গ বাড়ির ফয়সাল,গরু বাদশাহ, ,রফিক প্রকাশ বার্মাইয়া রফিক,ফুলের ডেইল এলাকার সাইফুল ইসলাম ভুট্টো, মৌলভী বাজারের আব্দুল্লাহ । হোয়াইক্যং ইউপির সাতঘরিয়া পাড়ার নুরুল আলম প্রকাশ ধইল্যা, মোহাম্মদ নুর প্রকাশ বার্মায়া নুর,নাছর পাড়ার আব্দুল্লাহ, মহেশখালীয় পাড়ার মমতাজ আহমদরে ছেলে কামরুল ইসলাম প্রকাশ আব্বুইয়া ,তিনি সব সময় অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করে । কুতুবদিয়া পাড়া এলাকার নুরুল হোছাইনের ছেলে আলমগীর,কানজর পাড়ার আব্দু শুক্কুরের ছেলে খাইরুল বশর প্রকাশ বার্মাইয়া খাইরুল,জিয়াউর রহমান,মিজানুর রহমান প্রকাশ আকাশ,হাবিবুর রহমান প্রকাশ আবিরান,শাহাবুদ্দিন,উলুবনিয়ার চকিদার বেলালসহ আরও অনেকে রয়েছে । এদের অনেকের বিরুদ্দে মাদকসহ ডজন, হাফ ডজন মামলা রয়েছে। সিন্ডিকেট ভেঙে এসব গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা গেলেই মাদক নিয়ন্ত্রণে আনা সমম্ভব হবে বলে মনে করেন স্থানীয় সুধী সমাজের লোকজন । কক্সবাজার সিটি কলেজের প্রভাষক এহ্সান উদ্দিন বলেন, মাদক করবারীদের সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রধান অথিতি করা হচ্ছে ,টাকার বিনিময়ে সম্মানের চেয়ারে মাদক কারবারীদের বসানো হচ্ছে ,এতে মাদক কারবারীরা তাদের মাদক ব্যবসা বৈধ এবং সম্মানের বলে মনে করছে। রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্টপোষকতা থাকার কারণে সহজেই এই মাদক ব্যবসা বন্ধ করা যাচ্ছে না । এই মাদক ব্যবসা বন্ধে সামাজিকভাবে মাদক কারবারীদের বয়কট করতে হবে এবং রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্টপোষকতা ছাড়তে হবে, তবেই এই মাদক ব্যবসা বন্ধ করা যাবে বলে আশা করা যায়। কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তারেক মাহমুদ রনি বলেন, নাফনদীর তীরে একটি দ্বীপ আছে ,সেটাতে রোহিঙ্গা শসস্ত্র মাদক কারবারীরা অবস্থান করে এবং সমাজের কিছু অসাধু মানুষ তাদের সহযোগিতা করার কারণে সীমান্ত অরক্ষিত থাকার সুবাদে বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ পিস মাদক প্রবেশ করছে । তিনি আরও বলেন, নাফনদীর তীরে নাফপুরার দ্বীপে সাড়াশি অভিযান চালিয়ে ওই দ্বীপকে রেডজোন ঘোষণা করলে মাদরের ঢল নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতে পারে । মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর টেকনাফ বিশেষ জোনের সহকারী পরিচালক সিরাজুল মোস্তফা জানান,উপর্যুপরি অপারেশন এবং আসামি গ্রেপ্তার এর মধ্য দিয়ে ২০২২ সাল শেষ করলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর টেকনা বিশেষ জোন । তথাপি এখনো মাদক পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। অধিদপ্তর ২০২৩ সালের মাদক বন্ধের জন্য ভিন্ন আঙ্গিকে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নতুন বছরে অধিদপ্তর মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করবে। এবং রুজুকিত মামলা সমূহের হালনাগাদ তথ্য তৈরি করার মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করা এবং অধিক গতিশীল করার দিকে গুরুত্ব দেবে। অধিদপ্তর বিশ্বাস করে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি হলে মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি কাজ করবে এবং সাধারণ কেউ আর মাদক ব্যবসা করায় উদ্বুদ্ধ হবেনা।
Posted ১:৪৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩
dbncox.com | Bijoy Kumar