তোফায়েল আহমদ | সোমবার, ২৫ জুন ২০১৮
সীমান্তের ইয়াবা কারবারের ভয়াল দুঃসংবাদ নিয়েই আজ ২৬ জুন বাংলাদেশ সহ বিশ্বে উদযাপন হচ্ছে ‘মাদ্রক দ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস-২০১৮।’ এ দিবসকে সামনে নিয়েই গত মাসের পহেলা সপ্তাহ থেকে দেশব্যাপি ইয়াবা সহ মাদক বিরোধী বড় ধরণের অভিযান শুরু হলেও ইয়াবা পাচারের গেইটওয়ে কক্সবাজারের সীমান্ত টেকনাফ-উখিয়ায় সেই অভিযানের তেমন জোরালো কোন ফলাফল দেখা যায়নি। এমনকি গত ২৭ মে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হক বন্দুক যুদ্ধে নিহত হবার পর সেই অভিযানটিই মূখ্যত ভাটা পড়েছে। তবে এ অভিযানে টেকনাফ সীমান্তে ১৪ জন খুচরা ইয়াবা কারবারিকে আটক ও অর্ধ শতাধিক ব্যক্তিকে ইয়াবা সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মোবাই্ল কোর্টে শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এদিকে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে আকস্মিক ইয়াবার দাম বেড়ে গেছে। বাড়তি দামের কারনে মাদক বিরোধী অভিযান চলাকালেও সীমান্তে অব্যাহত রয়েছে ‘নিরব ইয়াবা কারবার।’ নাফনদ তীরের ইয়াবা খালাসের প্রধান ঘাট যথাক্রমে খুরেরমুখ,সাবরাং নয়াপাড়া, মৌলভী পাড়া, শাহপুরীর দ্বীপ সহ সীমান্তের বিভিন্ন ইয়াবা মোকামে প্রতিটি ইয়াবা বড়ি পিছু গড়ে বেড়েছে কমপক্ষে ৫ টাকা।
গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশব্যাপি মাদক বিরোধী অভিযানের আগে নিন্ম মানের প্রতি পিচ ইয়াবা বড়ির দাম যেখানে ছিল ১৫ টাকা সেটি এখন ২০ টাকা। আর সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ৪০/৪৫ টাকায়। সেই সাথে রাজধানী ঢাকায়ও প্রতি পিচ ইয়াবার দাম বেড়েছে ৩০/৩৫ টাকা করে। ঢাকার ইয়াবা বাজারে বর্তমানে প্রতি পিচ ইয়াবা বড়ির দাম ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশব্যাপি মাদক বিরোধী অভিযানের আগে ঢাকায় যেটি ছিল ১২০ টাকা সেটি এখন ১৫০ টাকায় উঠেছে। টেকনাফ সীমান্তের নানা সুত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
সীমান্তের ইয়াবা কারবারের ভয়াল দুঃসংবাদ নিয়েই আজ ২৬ জুন বাংলাদেশ সহ বিশ্বে উদযাপন হচ্ছে ‘মাদ্রক দ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস-২০১৮।’ এদিকে গত মাসের পহেলা সপ্তাহ থেকে দেশব্যাপি ইয়াবা সহ মাদক বিরোধী বড় ধরণের অভিযান শুরু হলেও ইয়াবা পাচারের গেইটওয়ে কক্সবাজারের সীমান্ত টেকনাফ-উখিয়ায় সেই অভিযানের তেমন জোরালো কোন ফলাফল দেখা যায়নি। এমনকি গত ২৭ মে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হক বন্দুক যুদ্ধে নিহত হবার পর সেই অভিযানটিই মূখ্যত ভাটা পড়েছে।
মাদক তথা ইয়াবা বিরোধী অভিযানের পর থেকে ইয়াবার গেটওয়ে হিসাবে পরিচিত টেকনাফ সীমান্তের লোকজন এখন কেউই নিজের পরিচয় দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। তবে সরকারের ইয়াবা বিরোধী অভিযানের প্রতি সাধারণ মানুষের অসাধারণ সমর্থন রয়েছে। এটার প্রমাণ মিলে- সীমান্ত এলাকা জুড়েও অভিযান বিরোধী কোন ব্যক্তিকেও খুঁজে না পাওয়া। এমনকি সীমান্ত এলাকার সরকার বিরোধী প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র নেতৃবৃন্দও এমন অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে আসছেন।
টেকনাফ উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি জাফর আলম মেম্বার এবং উখিয়া উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদের সাথে আলোচনা করা হয় ইয়াবা বিরোধী অভিযান নিয়ে। বর্তমান সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে ঘোষিত বিএনপি’র তৃণমূলের রাজনৈতিক এই নেতাদ্বয়ও বলেছেন-‘ সরকারের মাদক বিরোধী অভিযানের বিরোধিতা করার কোন সুযোগ আমাদের নেই। কেননা ইয়াবার মত সর্বনাশা এমন জঘন্য মাদক আমাদের চোখের সামনেই বছরের পর বছর ধরে পাচার হয়ে আসছে। এতে করে জাতির সর্বনাশ হচ্ছে।’
দেশব্যাপি অভিযান চলাকালেও সীমান্ত গলিয়ে ইয়াবার চালান পাচার থেমে নেই। অভিযানের সময়েও কেন ইয়াবা পাচার অব্যাহত রয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে সর্বাগ্রে উঠে এসেছে আইন প্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যদের কথা। সীমান্তের লোকজন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন-‘যদি কিনা আইন প্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যরা লোভের উর্ধে উঠে দেশপ্রেম লালন করে থাকেন তাহলে একটি ইয়াবাও পাচার হতে পারবে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করণীয় দরকার-ইয়াবা কারবারিদের তালিকার সাথে সীমান্তে কর্মরত অসাধু বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদেরও তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়া।’
সীমান্তে ইয়াবা কারবারের এমন অসাধুতার চিত্র তুলে ধরে নাম প্রকাশে এক ব্যক্তি জানান-টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের একজন ইউপি মেম্বার এক রাতে নগদ চল্লিশ লাখ টাকা পর্যন্ত কামাই করেছেন। ভাগে মেম্বার পেয়েছিলেন দশ লাখ টাকা। সেই ইউপি মেম্বারই হচ্ছেন এমপি আবদুর রহমান বদির বেয়াই হিসাবে পরিচিত আকতার কামাল মেম্বার। গত ২৫ মে বন্দুক যুদ্ধে তিনি নিহত হন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ডন আকতার কামাল মেম্বারের ঘনিষ্ট আতœীয় ইয়াবা পাচারের কাহিনী নিয়ে বলেন-‘টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় ইয়াবার ঘাট হচ্ছে খুরেরমুখ। এখানে সরকারি সংস্থার সদস্যদের সাথেই দিনরাত কাটাতেন আকতার কামাল মেম্বার। রাতে নাফনদের এই ঘাট দিয়েই তিনি তুলতেন লাখ লাখ ইয়াবার চালান। আবার সেই সংস্থার সদস্যরাই নাকি তাকে ধরিয়েও দিয়েছে বলে শুনেছি।’
বন্দুক যুদ্ধে নিহত এমপি বদির বেয়াই আকতার কামালের আতœীয় আরো জানান, নাফনদ ঘাটে রাতের ইয়াবা পাচারের চিত্র হয়ে উঠে ভিন্ন রকমের। ইয়াবার চালান পাচারের সময় ঘটনাস্থলে যারাই উপস্থিত থাকেন সবাই একাকার হয়ে যান। এসময় কারো সাথে কোন মতবিরোধের সুযোগ থাকে না। নিহত আকতার কামাল চালান তুলে দিয়ে যেমনি ভাগে একরাতে দশ লাখ টাকা পেয়েছেন তেমনি আরো তিন ভাগেও আরো ত্রিশ লাখ টাকা ভাগ হয়েছে। তবে এখন প্রশ্ন উঠেছে-এক ভাগের আকতার কামাল বন্দুক যুদ্ধে নিহত হলেও অপর তিন ভাগ প্রাপ্তির সেই লোকগুলো কারা ? তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা ? নিহত আকতার কামাল মেম্বারের এই আতœীয় বলেন-এবার বলুনতো রাতে যদি দশ লাখ পেয়ে যান কে ছাড়বে এমন কারবারটি ?
ইয়াবা বিরোধী অভিযানে গত ২৫ মে আকতার কামাল মেম্বার এবং ২৭ মে টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক বন্দুক যুদ্ধে নিহত হবার পর তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিরা সবাই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। অনেকেই দেশ ছেড়ে গেছেন। টেকনাফের অনেক কারবারি মিয়ানমার অভ্যন্তরের সীমান্তে সেই দেশের ইয়াবা কারবারিদের সাথে চুক্তিতে আশ্রয় নেওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। এমনকি ইয়াবা সংশ্লিষ্টতায় বিতর্কিত এমপি আবদুর রহমান বদির খালাত ভাই মংমংসেন রাখাইন কাউন্সিলর একরাম নিহত হবার পরের দিনই শাহপরীর দ্বীপ ঘাট দিয়ে পাড়ি জমায় মিয়ানমারে।
মিয়ানমারের বন্দর শহর মন্ডুর বড় ইয়াবা কারবারি রোহিঙ্গা আবদুর রহিমের আশ্রয় প্রশ্রয়েও রয়েছে টেকনাফের বিপুল সংখ্যক ইয়াবা কারবারি। রোহিঙ্গা আবদুর রহিম হচ্ছেন ওপারের মিয়ানমার সরকারের একজন ঘনিষ্টজন হিসাবে পরিচিত ব্যক্তি। তিনিই মিয়ানমার থেকে এপারের বড় বড় ডনদের ইয়াবার চালান পাঠিয়ে থাকেন। রোহিঙ্গা আবদুর রহিমের ব্যবসায়িক সুবিধার্থে টেকনাফের কারবারিদের মিয়ানমার অভ্যন্তরে স্থান দেওয়ার কথা টেকনাফের অনেকেই জানেন।
এমপি আবদুর রহমান বদি, টেকনাফ উপজেলা পরিসদ চেয়ারম্যান জাফর আলম, উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিক আহমদ ও তার ভাই ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ আহমদ সহ আরো অনেক তালিকাভুক্ত কারবারি ওমরাহ হজ্বের নামে পাড়ি জমান সৌদি আরব। সৌদি আরব পাড়ি জমানো এমপি আবদুর রহমান বদি গত ১৭ জুন দেশে ফিরে আসলেও কারবারিদের অন্যান্যরা এখনো দেশে ফিরেছে বলে জানা যায়নি।
সীমান্ত এলাকার খোঁজ-খবর নিয়ে আরো জানা গেছে, ঈদ উপলক্ষে তালিকাভুক্ত কারবারিরা এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে। আবার যারা প্রকৃত কারবারি অথচ তালিকাভুক্ত হননি তারা যথারীতি এলাকায় অবস্থান নিয়ে যথারীতি ইয়াবার চালান পাচার অব্যাহত রেখেছে। তবে সবচেয়ে মজায় রয়েছে সীমান্ত এলাকায় ইয়াবা মওজুদকারিরা। যেহেতু বর্তমান অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতে ইয়াবার দাম চড়া তাই মওজুদকারিদেরই পোয়াবারু অবস্থা বিরাজ করছে।
তবে ইয়াবা কারবারের সবচেয়ে বড় ডন হিসাবে পরিচিত টেকনাফের শিলবনিয়া পাড়ার হাজী সাইফুল করিম, এমপি বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান, আবদুস শুকুর, ফয়সাল, এমপি বদির ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপু, মৌলভী পাড়ার একরাম, শাহজাহান চেয়ারম্যান, নাজির পাড়ার এনাম মেম্বার ও মৌলভী ভুট্টো এখনো গা ঢাকা দিয়ে থাকায় আপাতত বড় চালান পাচারের তেমন খবর মিলছে না। তবুও সীমান্তে ঘুরে ফিরেই কেবল কাউন্সিলর একরামের বন্দুক যুদ্ধে নিহত হবার কথাটিই উচ্চারিত হচ্ছে। অনেকেরই প্রশ্ন-‘তবে কি ইয়াবা ডনদের রক্ষার জন্যই বেচারা একরাম বন্দুক যুদ্ধের শিকার হলেন ?’ তারাই বলেন, একরাম হত্যার পর থেকেই এ পর্যন্ত কোনবড় কারবারি ধরাও পড়েনি।
এদিকে সীমান্ত এলাকায় এখনো প্রতিদিন ইয়াবার চালান আটক অব্যাহত রয়েছে। গত ১৮ জুন (সোমবার) রাতে টেকনাফের নাজির পাড়ার ইয়াবা কারবারি সৈয়দ আলমের গোয়াল ঘরে মওজুদ করে রাখা ইয়াবা উদ্ধার করেছে বিজিবি’র একটি দল। টেকনাফের বিজিবি-২ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল আছাদুদ-জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, গোয়াল ঘরটির এক কোণায় মাটি খুঁড়ে মওজুদ করে রাখা একটি পলিথিনের বান্ডিল উদ্ধার করা হয়। সেই বান্ডিল গণনা করে পাওয়া যায় ১৩ হাজার ২৬৫ পিস ইয়াবা। বিজিবি সদস্যরা আটক করেছে মওজুদকারি মোঃ সৈয়দ আলমকে।
টেকনাফের বিজিবি সুত্রে আরো জানা গেছে, গত মে মাসে মাদক বিরোধী অভিযান চলাকালেও উদ্ধার করা হয়েছে ৭ লাখ ৪২ হাজার ৮১২ পিস ইয়াবার চালান। এ পরিমাণ ইয়াবার মূল্য প্রায় ২১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এ সময়ে আটক করা হয়েছে ২৩ জন পাচারকারিকে। মে মাসে ইয়াবার মামলা হয়েছে ৪৯ টি। এপ্রিল মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৪ পিস ইয়াবা। এ পরিমাণ ইয়াবার মূল্য প্রায় ২৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এ মাসে ৬২ টি মামলা সহ আটক হয় ২৪ জন পাচারকারি। মার্চ মাসে উদ্ধার করা হয় ২১ লাখ ৬ হাজার ইয়াবা। যার মূল্য প্রায় ৬৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ মাসেও ধরা পড়ে ২৯ জন পাচারকারি এবং মামলা হয়েছে ৫৪টি। #####
Posted ১১:৪১ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৫ জুন ২০১৮
dbncox.com | ajker deshbidesh